সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। এই উপজেলার চৌধুরী বাড়ি এলাকায় ৫৪ বছর ধরে একই আঙিনায় পাশাপাশি মসজিদ-মন্দিরে দুই ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মমতে নামাজ আদায় ও পূজা পালন করে আসছেন।
এ বছরও মসজিদের পাশেই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। আজান ও নামাজের সময় বন্ধ থাকছে পূজার কার্যক্রম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নাগরপুরের চৌধুরী বাড়িতে ৯২ বছর আগে ১৯৩২ সালের সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় উঝা ঠাকুর কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে এখানে চৌধুরী বাড়ি ক্লাব স্থাপিত হয়। ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছরই ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয় দুর্গাপূজা।
মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছর পর ১৯৭২ সালে একই আঙিনায় নির্মাণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। একইস্থানে মসজিদ আর মন্দির নিয়ে কখনও দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে আপত্তি ওঠেনি। এলাকার মানুষ মিলেমিশে নিজেদের ধর্ম পালন করছেন।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় মসজিদ ও দুর্গা মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরে চলছে পূজা আর্চনা। পূজারি ও দর্শনার্থীরা আসছেন প্রতিমা দেখতে এবং পূজায় অংশ নিতে। নির্ধারিত সময়ে আজান শুরুর আগেই থেমে যায় পূজার যাবতীয় কার্যক্রম। নামাজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার বেজে ওঠে মন্দিরের মাইক, ঢাক-ঢোল। দেওয়া হয় উলুধ্বনি। শুরু হয় পূজার কার্যক্রম।
নামাজি ও পূজারিরা জানান, এখানকার মানুষ শান্তিপ্রিয়। কোনোদিন কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে। তাদের প্রত্যাশা যুগযুগ ধরে অব্যাহত থাকবে এই সম্প্রীতি।
স্থানীয় বাসিন্দা সুপ্রিয় সাহা বলেন, “এখানকার পূজাটা বহুবছর আগের পুরোনো। এখানে পূজা উদ্যাপিত হচ্ছে, পাশেই মসজিদ আছে হিন্দু-মুসলমান আমরা একত্রিত হয়ে পূজা উদ্যাপন করি। আমাদের অনেক ভালো লাগে।”
লিপি চক্রবর্তী ও মিতু সাহা নামের আর দুজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “৫৪ বছর ধরে আমরা এখানে পূজা করছি। নামাজের সময়সূচি মেনে আমরা দুর্গাপূজা পালন করছি। নামাজের সময় আমার পূজার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। মসজিদের লোকজন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করছে। আমরাও তাদের সহযোগিতা করছি।”
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান সোহেল বলেন, “ভ্রাতৃত্বপূর্ণভাবে আমরা যার যার ধর্ম পালন করছি। আমরা এখানে কোনো ভেদাভেদ করি না যে, কে হিন্দু বা মুসলমান। বিপদে আপদে আমরা সবসময়ই তাদের সহযোগিতা করছি।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে এটি যেন নিদর্শন হয়ে থাকে, দেশের সমস্ত জায়গার মানুষ যেন এভাবে চলতে পারে সেটি আমাদের আশা। এমন মূল্যবোধ ধারণ করলে পৃথিবীর কোথাও অশান্তি হবে না।”
মসজিদের ইমাম আব্দুল লতিফ বলেন, “আমি এখানে প্রায় ৩৭ বছর ধরে ইমামতি করছি। মসজিদের প্রাশেই ঈদগাঁ ময়দান। তার পাশেই মন্দির রয়েছে। প্রতিবছরই এ মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দূর্গাপূজার সময় এখানে লোক সমাগম প্রচুর হয়।”
চৌধুরী বাড়ি উঝা ঠাকুর কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির ক্লাবের সভাপতি লিটন কুমার সাহা পোদ্দার বলেন, “৫৪ বছর ধরে আমরা এখানে পূজা পালন করছি। পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দির একসঙ্গে ধর্মীয় উৎসব পালন হয়। এতে কোনো সমস্যা হয় না, মুসলিম ধর্মের মানুষ আমাদের সহযোগিতা করে।”
এ প্রসঙ্গে নাগরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) দীপ ভৌমিক “একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দিরে নিজ-নিজ ধর্ম সামাজিক বজায় রেখে নামাজ ও পূজা পালন করে আসছে। এখানে সম্পীতির অন্যন্য উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।” আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবসময়ই মনিটরিং করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম শানতু বলেন, “জেলায় প্রায় ১,১০০ মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিটি মণ্ডপে পুলিশ এবং আনসারের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনীও দায়িত্ব পালন করছে। চৌধুরী বাড়ি এলাকায় মসজিদের পাশেই মন্দির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটিই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বাংলাদেশ। এমন বাংলাদেশ আমরা সবাই প্রত্যাশা করি।”
বিআরইউ