বর্তমানে যারা ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের সাথে যুক্ত হতে চাচ্ছেন এবং ফ্রিল্যান্সিংকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাদের জন্য প্রয়োজন ফ্রিল্যান্সিং জগত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং সুস্পষ্ট ধারনা যা আপনাদের ক্যারিয়ার গঠনে অনেক সহায়ক এবং যথেষ্ট ভুমিকা রাখবে আশা রাখি।
ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে এমন কিছু মারাত্মক ভুল আছে যা কম-বেশি সবাই করে থাকে, যে সামান্য ভুলগুলো হতে পারে তার ক্যারিয়ারের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ।
সঠিক দিক নির্দেশনা বা গাইডলাইনের অভাবে সাধারণত এই ভুলগুলো হয়ে থাকে। তাই আপনাদের সামনে আজ উপস্থাপন করবো ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে এমন মারাত্মক ভুল, যা থেকে আপনি অবশ্যই বিরত থাকবেন এবং অন্যকেও এই ভুল থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিবেন।
১. প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা অর্জন ছাড়াই ফ্রিল্যান্সিং শুরু করা
আপনার বন্ধু বা পরিবার মহলে এমন কেউ আছে যিনি সরাসরি এই ফ্রিল্যান্সিং এর সাথে যে ফ্রিল্যান্সিং করে অনেক অর্থ উপার্জন করছেন অথবা ডিজিটাল মাধ্যমে আপনি এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয়।
ভুলেও এসব রংচটা বিজ্ঞাপন নজরে আনবেন না বা গায়ে মাখবেন না। কারণ আপনি জানেন না, আপনার দক্ষতা আসলে কোন জায়গায়? বা কোন দক্ষতা অর্জন করে আপনি সফল হতে পারবেন? অনেকে কোন ধরণের স্কিল বা দক্ষতা অর্জন না করেই ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে একটা একাউন্ট তৈরি করে ফেলেন।
তিনি আসলে নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা অর্জন না করে মার্কেটপ্লেসের বিভিন্ন কাজের জন্য আবেদন করতে থাকেন।
আবার অনেকে মনে করেন, মাইক্রোসফট এক্সেল আমার খুব ভালো দক্ষতা আছে আমি ডাটা এন্ট্রির কাজ খুব ভালো পারবো। কিন্তু মার্কেটপ্লেসে ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কি কাজ হয়? কোন ধরণের কাজের সুযোগ রয়েছে? কোন কাজে ভবিষ্যত সম্ভাবনা আছে তা বিচার বিশ্লেষণ না করে কাজ শুরু করে দেন। পরবর্তীতে যখন মাঝ রাস্তায় বিপদে পড়ে তখন আর পেছনে ফেরার উপায় থাকে না।
বর্তমানে গ্রাফিক্স ডিজাইন থেকে শুরু করে ডিজিটাল মার্কেটিং এবং অন্যান্য বিষয়ে চাহিদাসম্পন্ন অনলাইন কোর্স আছে যা স্বল্পমূল্যে ভর্তি হয়ে কোর্স সম্পন্নের মাধ্যমে আপনি অর্জন করতে পারেন দক্ষতা এবং পারদর্শিকতা।
২. সঠিক মার্কেটপ্লেস নির্ধারণ না করা
বর্তমানে সারা বিশ্বে আপওয়ার্ক, ফাইভার, ফ্রিল্যান্সার, পিপল পার আওয়ার ছাড়াও অনেক মার্কেটপ্লেস আছে যেখানে একজন ফ্রিল্যান্সার চাইলেই ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার অনায়াসে শুরু করতে পারেন। সব মার্কেটপ্লেস মোটামুটি একইভাবে কাজ করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে এর ভিন্নতা। ঠিক সেভাবে ভিন্নতা রয়েছে তাদের ধরণ এবং নীতিতে।
যেমন আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার মার্কেটপ্লেস যেভাবে কাজ করে, ফাইভার মার্কেটপ্লেস এর ধরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপওয়ার্কে নির্দিষ্ট কাজের জন্য বায়ারদের আবেদন করতে হয় আর ফাইভারে আপনার সার্ভিস অনুযায়ী বায়ার আপনার কাজের অর্ডার প্লেস করেন।
আবার সব মার্কেটপ্লেস পেমেন্ট সিস্টেম থেকে শুরু করে বিজনেস পলিসি এক নয়। আবার কিছু মার্কেটপ্লেসে কাজ এবং সেবার রয়েছে যথেষ্ট ভিন্নতা। তাই মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে আপনার সুস্পষ্ট ধারণা এবং সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। তাদের পলিসি, রুলস, রেগুলেশন সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে এবং তা সঠিক ভাবে মেনে চলতে হবে।
তার উপর ভিত্তি করে আপনাকে মার্কেটপ্লেস নির্ধারণ করতে হবে আপনি কোন মার্কেটপ্লেস নিজের ক্যারিয়ার শুরু করবেন এবং আস্তে আস্তে সামনে অগ্রসর হবেন।
৩. অর্ডার গ্রহনের সময় অসাবধানতা এবং অসচেতনতা
ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে সবচেয়ে মারাত্মক যে ভুলটি সবাই কম বেশি করে থাকে তা হচ্ছে- না জেনে বা না বুঝে কাজের অর্ডার গ্রহণ করা এবং সব ধরণের প্রজেক্টে নিজেকে সংযুক্ত করা। পৃথিবীর সব কাজ যে আপনাকে জানতে হবে তার জন্য কিন্তু আপনি বাধ্য নন। আবার আপনি যে কাজে দক্ষতা অর্জন করেছেন সেই কাজের খুটি নাটি সবকিছু আপনাকে জানতে হবে।
অনেকেই আছেন যারা বায়ার বা ক্লায়েন্ট যে কাজ চাচ্ছেন তা সুস্পষ্ট না জেনে বা না বুঝে গ্রহণ করেন কিন্তু পরবর্তীতে যখন ক্লায়েন্টকে সেই সার্ভিস দিতে ব্যর্থ হোন তা নিয়ে ঘটে বিপত্তি।
ভুলেও কখনো না জেনে বা না বুঝে ক্লায়েন্ট থেকে কোন সার্ভিস অর্ডার গ্রহণ করবেন না। আপনার একটা নেগেটিভ রিভিউ আপনার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে করে দিতে পারে এক বিশাল ক্ষতি যা কোনভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়।
৪.যথা সময়ে দ্রুত ক্লায়েন্টকে সাড়া না দেয়া
আপনি যদি মার্কেটপ্লেসে নতুন হয়ে থাকেন তাহলে এই ভুল কখনোই করবেন না। ক্লায়েন্ট বা বায়ার আপনার প্রোফাইল এবং পোর্টফলিও দেখে আপনাকে কোন কাজের জন্য সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে তাহলে যত ব্যস্ততাই থাকুক, খুব দ্রুত সেই ডাকে সাড়া দিন।
৫. দক্ষতা এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে উদাসীনতা
ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে আপনাকে হতে হবে সবচেয়ে প্রডাকটিভ এবং সেই সাথে হতে হবে প্রো এক্টিভ। শুধু একটা স্কিল নিয়ে বসে থাকলে হবে না। ধীরে ধীরে আপনার সেকটর অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকুন।
৬.মার্কেটপ্লেসের বাইরে কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত না করা
আপনি যে আজীবন মার্কেটপ্লেস কাজ করবেন তা কিন্তু নয়। মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে আপনার পোর্টফোলিও প্রস্তুত করতে থাকুন। নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করুন। নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করুন।
৭.মার্কেটপ্লেসের ক্লায়েন্টদের মার্কেটপ্লেসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা
এটি সবচেয়ে গুরুতর এবং মারাত্মক ভুল হবে যদি আপনি এই চেষ্টা করে থাকেন। আপওয়ার্ক, ফাইভার সহ অন্যান্য মার্কেটপ্লেস যদি কোনভাবে জানতে পারেন আপনি আপনার বায়ারদের মার্কেটপ্লেসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তাহলে তারা আপনার একাউন্ট ব্যান বা ডিএক্টিভ করে দিতে পারে। তাই এই রিস্ক নেওয়ার কোন দরকার নেই।
৮. মার্কেটিং এবং সেলস সংক্রান্ত স্কিল ডেভেলপ না করা
ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে গেলে অবশ্যই আপনার মার্কেটিং এবং সেলস নিয়ে ধারণা থাকতে হবে। এই দক্ষতার উপর ভিত্তি করে আপনি আপনার ক্যারিয়ার অথবা ব্যবসায়িক প্রসার ঘটাতে পারবেন। তাই অন্য সফল ফ্রীল্যান্সার কিভাবে নিজের মার্কেটিং এবং সেলস ফানেল নিয়ে কাজ করছে তার উপর ভিত্তি করে আপনার পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
৯. লিডারশীপ এবং কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ না করা
জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে লিডারশীপ এবং কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করা অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ। ভবিষ্যতে অগ্রসর হতে হলে আপনার অবশ্যই লিডারশীপ স্কিল থাকা বাঞ্চনীয়। সেই সাথে কমিউনিকেশন স্কিল থাকা অনেক বেশি জরুরী।
ক্লায়েন্ট এর সাথে কিভাবে কথা বলা শুরু করতে হবে? কথা বলার সময় কি কি জিনিষ মাথায় রাখতে হবে? এসব বিষয়ে আপনার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা থাকা জরুরী।
১০. নেটওয়ার্কিং নিয়ে উদাসীনতা
নেটওয়ার্কিংও এক বিশেষ ধরণের যোগ্যতা। আপনার কমিউনিটিতে অন্যের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং তা বজায় রাখার গুণ অবশ্যই থাকতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে তারা আপনাকে সহায়তা প্রদান করতে পারেন।
১১ .নিজের সামান্য স্বার্থে মার্কেটপ্লেস দূষিত করা
মার্কেটপ্লেসে এমন অনেককে খুজে পাবেন যারা সামান্য স্বার্থে মার্কেটপ্লেস দুষিত করে- খুব নগণ্য মূল্যে সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমে। যার জন্য সেই সেক্টরের মার্কেট চাহিদা এবং ভ্যালু কমে যায়।যা আপনার সাথে সাথে অন্যের জন্য ক্ষতিকর।
১২. নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সম্পাদন না করা এবং প্রতিজ্ঞা ভংগ করা
নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সম্পাদন না করা এবং যে সার্ভিস ক্লায়েন্টকে বুঝিয়ে দিবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন তা বুঝিয়ে না দেয়া সবচেয়ে বড় ভুল। কি কি ফাইল বা মাস্টার কপি আপনি জমা দিবেন তা কাজ শুরুর পূর্বে আলোচনা করে নিন এবং কাজ শেষে জমা দিন। আপনার কাজে অসুন্তুষ্ট হয়ে ক্লায়েন্ট দিতে পারে আপনাকে একটি নেগাটিভ রিভিউ যা আপনার ক্যারিয়ারের জন্য হতে পারে ক্ষতিকর।
প্রত্যেক ফ্রিল্যান্সারের উচিৎ উপরোক্ত ভুলগুলো সম্পর্কে অবগত থাকা এবং তা থেকে বিরত থাকা। এতে আপনার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার হবে সফল এবং ব্যাপক সম্ভাবনাময়ী। আশা করি এই আর্টিকেল আপনাদের ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার গঠনে সহায়ক এবং সঠিক গাইডলাইন পেতে সহায়তা করবে।