অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে মেশিন বিকল

মাহমুদুল হাসান ও মেহেদী হাসান মাসুদ (বালিয়াকান্দি) প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২২, ০৬:২৫ এএম
অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে মেশিন বিকল

প্রান্তিকে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সূচনা। আধুনিক চিকিৎসার পূর্বশর্ত রোগ নির্ণয়। কিন্তু লোকবল সংকটে প্রান্তিকে বাড়েনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সুবিধা। অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে মেশিন বিকল! মেশিন থাকলেও নেই অপারেটর। কোথাও অপারেটর থাকলেও অচল এক্স-রে মেশিন। 

অভিযোগ রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে এক্স-রে মেশিন সচল ও অপারেটর রয়েছে সেখানে চিকিৎসকের কমিশনের লোভে ক্লিনিকে পাঠানো হচ্ছে রোগী। লোকবল সংকট আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কাজে আসছে না সরকারের শতকোটি টাকার উদ্যোগ। সারা দেশে ৩৯২টি এক্স-রে মেশিন বিকল। এতে নষ্ট হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটিরও বেশি টাকা। অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন ধরে রোগ নির্ণয়ের সেবা থেকে বঞ্চিত লাখ লাখ মানুষ। রোগ নিয়ন্ত্রণে ভরসা এখনো বেসরকারি খাত। ফলে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে সুবিধাবঞ্চিত হওয়ায় রোগী ও স্বজনরা দায়ী করছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে। সরেজমিন বরিশাল, শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, নেত্রকোনা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি জেলা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ হাসপাতালে নেই এক্স-রে সুবিধা। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত মঙ্গলবার সকালে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নতুন ভবনের নিচ তলায় একটি কক্ষে চায়না থেকে আমদানিকৃত ১০০এমএ, জি-১৭১৫ মডেলের একটি নতুন এক্স-রে মেশিন অযত্মে মরিচা ধরেছে। 

সরকারি তথ্য বলছে, আট লাখ ৮৭ হাজার ৬৭২ হাজার টাকায় আমদানিকৃত এক্স-রে মেশিনটি ২০২০ সালের আগস্টে হাসপাতালে স্থাপনা করা হয়েছে। টেকনোলজিস্টের অভাবে সচল মেশিনে আজও কোনো এক্স-রে করা হয়নি।

সরকারি তথ্য বলছে, এর আগে ১৯৯২ সালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে একটি এক্স-রে মেশিন সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই মেশিনও লোকবলের অভাবে ব্যবহার হয়নি। তবে পুরোনো মেশিনটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এক্স-রে, অ্যানেস্থেসিয়া মেশিন বরাদ্দ হলেও লোকবলের অভাবে সচল থেকে অচল হয়ে পড়ে। অথচ বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহিঃবিভাগে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ জনের এক্স-রে করার প্রয়োজন হয়। 

কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, এখানে জনবল নেই বলে বাইরে থেকে এক্স-রে করতে হবে। বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন বলেন, দুই বছর আগে নতুন এক্স-রে মেশিন পেলেও জনবলের অভাবে সেটি চালু করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি একাধিকবার যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। 

এদিকে লক্ষ্মীপুর জেলার চার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সচল এক্স-রে মেশিন। কিন্তু একটিতেও নেই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওলোজি)। রায়পুর ১২ বছর, রামগঞ্জ ১০ বছর, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আট বছর ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের (রেডিওলোজি) পদটি শূন্য রয়েছে। একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, শতাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করলেও এর কোনো সুরাহা মিলছে না।

লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহাম্মদ কবীর বলেন, আমার জেলার চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮-১২ বছর জনবল সংকটের কারণে সচল এক্স-রে মেশিনগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বিষয়টি বহুবার অধিদপ্তরকে জানানো হলেও কোনো কাজ হয়নি। ফরিদপুর জেলার সাতটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একাধিক সচল এক্স-রে মেশিন থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার হচ্ছে না। 

একাধিক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, আউটডোরে প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। হাড়ভাঙাসহ বিভিন্ন কারণে গড়ে ১৫-২০ জন রোগীকে এক্স-রে করার প্রয়োজন হয়। এক্স-রে মেশিন থাকলেও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদ শূন্য থাকা, লোকবল থাকলেও বিকল এক্স-রে মেশিন। আবার অনেক সময় যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামতের অভাবে পড়ে থাকে বছরের পর বছর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ৪৩১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৪৬টি এক্স-রে মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৫৪টি সচল। অচল ৩৯২টি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ঘিরে গড়ে ওঠে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কতিপয় ব্যক্তির অনৈতিক সখ্যতা থাকে। 

এছাড়াও ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ব্যবসায় পার্টনারশিপ থাকে কতিপয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মরত একাধিক ব্যক্তির। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিকস সেন্টারের সংশ্লিষ্ট অনেকের হাত রয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাওয়া রোগ নির্ণয়ের মেশিনপত্র বছরের বছর পর পড়ে থাকলেও সেগুলো স্থাপনে প্রতি মাসে মাঠপর্যায় থেকে প্রতিবেদন পাঠালেও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। মূল্যবান এসব নতুন মেশিনপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে প্রেরণ করলেও সেগুলো প্রতিস্থাপনে চরম অবহেলা দেখা গেছে। রাজবাড়ী সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী জেলার চার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে শুধুমাত্র গোয়ালন্দ উপজেলায় এক্স-রে সেবা পাওয়া যায়। 

সেখানে দুটি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে একটি সচল এবং অপারেটর রয়েছে, তবে সেটিও মাঝে মাঝে অচল হয়ে পড়ে। পাংশার এক্স-রে মেশিনটি দীর্ঘদিন অচল রয়েছে। বালিয়াকান্দি, কালুখালী একটি করে সচল এক্স-রে মেশিন থাকলে এখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের (রেডিওলোজি) পদ শূন্য। দেড় যুগের বেশি সময় ধরে অচলাবস্থায় আছে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে মেশিনটিও। 

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অর্ধযুগ ধরে একটি এক্স-রে মেশিন অচল পড়ে আছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওলজি) যোগদান করেছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটিতে নতুন একটি এক্স-রে মেশিন বরাদ্দ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত সেটি চালু হয়নি। স্বাস্থ্যসেবায় জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ হওয়া খানসামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতেও ২০১৭ সাল থেকে এক্স-রে মেশিন বিকল হয়ে পড়ে আছে। 

সম্প্রতি জাইকা প্রজেক্ট থেকে একটি নতুন এক্স-রে মেশিন পাওয়া গেলেও সেটি এখনো চালু হয়নি। অপারেটর থাকায় খুব শিগগিরই জনগণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি থেকে এ সেবা নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন আরএমও। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০০৮ সাল থেকে এক্স-রে মেশিনটি অচল। 

ভুক্তভোগীদের দাবি— এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে করাতে ১২০ টাকা লাগে, সে একই এক্স-রে বাইরে থেকে করাতে খরচ হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বলেন, প্রতিদিন দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের ভিড় থাকে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল কম হওয়ায় একজনকে কয়েকগুণ বেশি কাজ করেও কাজ শেষ করা যায় না। অথচ হাজার হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বেকার পড়ে আছে। তাদের কাজে লাগাতে উদ্যোগ নেই অধিদপ্তরের।

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএমটিএ) সদস্য সচিব শামীম শাহ বলেন, সরকারি হাসপাতালসহ সারা দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদে মহাসংকট থাকলেও নিয়োগের ক্ষেত্রে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে লক্ষাধিক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন। একদিকে প্রায় ২৫ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বেকার পড়ে আছে অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার মেশিনপত্রগুলো অচল অবস্থায় রেখে নষ্ট করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তিনি ২০১৩ সালের স্থগিত নিয়োগ সম্পন্নসহ নতুন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করে তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দাবি জানান।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, অপারেটর বা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট না থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ঘিরে সরকারের উদ্যোগ ব্যাহত হচ্ছে। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে সরকার। সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন থাকার পরও অপারেটরের অভাবে রোগী যখন বাইরে থেকে এক্স-রে করাচ্ছে, তখন রোগীরা ভাবে বাড়তি পয়সার লোভে হয়তো ডাক্তার বাইরে এক্স-রে করতে বাধ্য করছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতায় এই ভোগান্তি। দ্রুত টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। নয়তো প্রান্তিকের মানুষকে ঘিরে সরকারের পরিকল্পনা ব্যাহত হবে। অচল মেশিনগুলো মেরামত করে সাধারণ মানুষের ভুলের অবসান ও প্রান্তিতে স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধিতে সরকারের উদ্যোগ এগিয়ে নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা হেলথ কেয়ার বিভাগের লাইন ডাইরেক্টর ডা. মো. রেজওয়ানুর রহমান বলেন, অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নেই। এতে সেবা ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু তাদের নিয়োগের ক্ষমতাও আমাদের নেই। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে বিবেচনার বিষয়। আমরা শুধু চাহিদার অনুপাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে ও অ্যানেস্থেসিয়াসহ অন্যান্য মেশিন বরাদ্দ দিয়ে থাকি। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ প্রদান সম্ভব হলে প্রান্তিকে সেবা পৌঁছে দেয়া সহজ হবে। 

বিকল এক্স-রে মেশিনের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো স্থানীয়ভাবে মেরামত করে সচল করতে হবে। নয়তো সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে লিখিত জানালে অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে।