ইভটিজিং, অসামাজিক কার্যকলাপ, মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের আড্ডায় নগরের পার্কগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। বেড়েছে হকারদের দৌরাত্ম্য, বসেছে মৌসুমি ফলের জমজমাট হাট।
নগরবাসী নারীদের অনেকেই জানান, ভবঘুরে আর বাউণ্ডুলেদের আড্ডার স্থানে পরিণত হওয়ায় পার্কে যেতে ভয় পান তারা। ঘনবসতি, জ্যাম ও নিরাপদ বিনোদনের সুযোগের অভাবে হাঁসফাঁস দশা তাদের।
সব মিলিয়ে অনিরাপদ পার্কেই অবসর সময় কাটাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। রাজধানীর প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।
তবে প্রতিষ্ঠান দুটির কাজের সফলতায় পার্ক, উন্মুক্ত স্থানসহ পার্কে নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে নগরবাসীর। পার্ক ও উদ্যানকে নগরবাসীর জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে সবার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিতে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক, ওয়ারী এলাকায় অবস্থিত বলদা গার্ডেন, মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, গুলিস্তান শহীদ মতিউর পার্কসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, বাহদুর শাহ পার্ক সকাল ৭-৮টা পর্যন্তই কাজে লাগে স্থানীয়দের।
দিন বাড়ার সাথে চলে যায় ভবঘুরেদের দখলে। সন্ধ্যার পর বসে নেশাগ্রস্তদের আড্ডা। মাদকসেবন করে ঘুমিয়ে পড়ে পার্কেই। ভোর বেলায় ব্যায়াম করতে আসা বাসিন্দারা এতে বিব্রত অবস্থায় পড়েন। ফলে চক্ষুলজ্জা ও ভয়ে অনেক নারী এ পার্কে ব্যায়াম করতেই আসেন না। যারা আসেন তারা একরকম বাধ্য হয়েই আসেন।
এছাড়া বলদা গার্ডেনের ভেতরে উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীরা আড্ডা জমান। তাদের নানানরকম অঙ্গভঙ্গির ফলে স্থানীয়রা পার্কটিতে যান না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। ফলে লাজ লজ্জার ভয়ে শুধু স্থানীয়রাই নন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারাও বলদা গার্ডেনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
তাদের অভিযোগ, এই গার্ডেনে ছেলে-মেয়েরা যেসব কার্যকলাপ করে ফলে তারা বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়েন। এদিকে গুলিস্তানের শহীদ মতিউর পার্কসহ অনেক পার্কের সামনে বসেছে মৌসুমি ফলের হাট। সকাল-সন্ধ্যা পার্কের ভেতর-বাইরে হকারদের আনাগোনাও বেড়েছে। এদিকে ফুটপাত দখলে থাকায় চলাচলে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
পাশাপাশি অনুকূল পরিবেশের অভাবে পার্কে অবসর সময় কাটাতে পারছেন না নগরবাসী। শুধু এ পার্কগুলোতেই এমন দৃশ্য নয়, রাজধানীর অন্যান্য পার্কেও একই রকম অবস্থা বিরাজমান।
এছাড়াও সন্ধ্যার পর অফিসগামী নারীরা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে ভয় পান। কারণ সেখানে মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীরা সুযোগ বুঝে নারীদের গায়ে হাত দেয় ও ব্যাগ নিয়ে দৌড় দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।
নগরবিদরা জানান, নগরীর নির্মল পরিবেশ ও মানুষের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন পার্কগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পার্ক টিকিয়ে রাখ।
এসব পার্ক যথাযথভাবে সংরক্ষণে আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। একটি আদর্শ নগরে মোট আয়তনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন। অথচ ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা ৬-৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
পার্ক শুধু অবসর বিনোদনের আধার নয়, নগরীর ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ ধারকও। সিটি কর্পোরেশনকে শক্ত অবস্থান নিয়ে পার্কগুলো পুনরুদ্ধার এবং এর যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বের অন্য শহরগুলো কীভাবে তাদের উদ্যান ও পার্ক রক্ষণাবেক্ষণ করছে, সেই অভিজ্ঞতা বিনিময়ে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দখল-দূষণে ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা। বায়ুর মান খুবই খারাপ। ঢাকা শহরে বাস উপযোগিতা নিশ্চিতে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা বাড়ানোর বিকল্প নেই। সে জন্য প্রথমত, পার্কগুলো সংরক্ষণ ও অবৈধ দখলমুক্ত করা জরুরি।
একই সাথে নগরবাসী যেন সেখানে গিয়ে গুণগত সময় কাটাতে পারেন সে জন্য নিরাপত্তা, স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বাহাদুর শাহ পার্কে নিয়মিত ভোর বেলায় হাঁটতে আসেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, এমনিতেই পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য একটি মাত্র পার্ক। এখানে না এসে উপায় নেই। বাধ্য হয়েই আসি।
এছাড়া এ পার্কে আমার স্ত্রী আসতে চান না। কারণ এখানে মাদকসেবীরা বিব্রতকর অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকে এবং তাদের অনেকের হাতে ব্লেডও থাকে। আমরা যারা আসি সর্বোচ্চ সকাল ৮টা পর্যন্ত এ পার্কটি ব্যবহার করতে পারি। দিন বাড়ার সাথে এখানে মৌসুমি ফলের ব্যবসাও জমে উঠতে থাকে।
পাশাপাশি হকারদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। একটু স্বস্তিমত ব্যায়াম করা যায় না। সন্ধ্যার পরও আসতে মন চায় না। কারণ সন্ধ্যা নামলেই মাদকসেবী ও কিশোরগ্যাংয়ের আড্ডা জমে উঠতে থাকে।
ওয়ারী এলাকার বাসিন্দা তপন কুমার বলেন, বলদা গার্ডেনের পরিবেশের বিষয়ে যারা জানেন তারা এখানে আসতে চান না। ছেলে-মেয়েরা এখানে এসে যেসব অঙ্গভঙ্গি করে তাতে আমাদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তাই অনেকদিন হলো বলদা গার্ডেনে আসি না।
রাজধানীর নর্দ্দা এলাকার বাসিন্দা নাসরিন আক্তার জানান, অফিস শেষ করে রিকশা না পেলে শাহাবুদ্দিন পার্ক ও লেক পার্ক দিয়ে হেঁটে বাসায় যান। শাহাবুদ্দিন পার্কের পরিবেশ অনেকটা ভালো ও নিরাপত্তাও ঠিক আছে। তাই বাসায় যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে পার্কের ভেতর অবসর সময় কাটায়।
তবে এ পার্কের সামনে রাস্তার পাশে মাদকসেবীরা মাঝে মাঝে আড্ডা বসায়। সহজে তাদের বুঝা যায় না। একদিন আমি হেটে বাসায় যাচ্ছিলাম তখন আমার ব্যাগ নিয়ে তারা দৌড় দেয়। তাই ভয়ে এ পার্ক এর পাশ দিয়ে হেঁটে আর যায় না।
মিরপুর জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে আসা নকীব ও তার মা আফরোজা হালিমা বলেন, গাছপালা দেখতে অনেক ভালো লাগে। তবে মা ছেলে ঘুরতে এসে একটু লজ্জার ভেতর পড়তে হয়েছে ও ভয়ও হয়। কারণ হকারদের কাছ থেকে কিছু কিনলে সেটির দাম চারগুণ বেশি রাখে। আরও কিছু সমস্যা আছে সেগুলো বলতে তো লজ্জাও লাগে। আপনি বুঝে নেন।
স্থপতি ইকবাল হাবিব দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, শুধু পার্কগুলো কেবল উন্নয়ন করলেই হবে না, তা রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য কাউন্সিলর, স্থানীয় এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে সিটি কর্পোরেশন একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করতে পারে। তাহলে শুধু বলদা গার্ডেনসহ অন্যান্য পার্কেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সার্বিক বিষয়ে জানতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কর্মকর্তাদের একাধিকবার ফোন করেও কাউকেও পাওয়া যায়নি।