পরিবেশ সংরক্ষণে আইন আছে; আদালতও আছে। তবে এ আদালতে পরিবেশ-সংক্রান্ত মামলার বিচার হয় না। বিচার চলে চেক জালিয়াতি মামলার। আবার আইন থাকলেও প্রয়োগে রয়েছে নানা দুর্বলতা। দূষণ রোধে কার্যকরী ভূমিকা নেই পরিবেশ অধিদপ্তরেরও। ফলে বাড়ছে পাহাড় কাটা, অবৈধ ইটভাটা, নিষিদ্ধ পলিথিন, বায়ুদূষণ, অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, পুকুর ও জলাশয় ভরাট। এতে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না দূষণকারীদের। দূষণ প্রতিরোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট চলছে।
তবে কাউকে আটক করা হচ্ছে না। শুধু জরিমানা করেই ছেড়ে দেয়া হয়। যার ফলে পরিবেশ আদালতে মামলাই যাচ্ছে না। যা যাচ্ছে, তাও নামমাত্র। পরিবেশ-সংক্রান্ত ৯০ শতাংশ অভিযোগ ও মামলা পাঠানো হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতে। ফলে অনেকটা কাজহীন পড়ে আছে ২০০০ সালে গঠিত তিনটি পরিবেশ আদালত। মামলা না থাকায় পরিবেশবিষয়ক অপরাধের পরিবর্তে করছে অন্য মামলার বিচার।
এদিকে নির্দিষ্ট আদালত থাকতে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করায় পরিবেশ আদালত সৃষ্টির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এছাড়া পরিবেশ রক্ষায় উচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশনা রয়েছে। তবে যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে না। এ জন্য প্রয়োজন পরিবেশ ধ্বংস এবং দূষণে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে সাজা নিশ্চিত করা। এমনটি মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবেশ আদালতের অল্পসংখ্যক মামলা নিয়েও বিচারে চলছে ধীরগতি। নিষ্পত্তিতে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। আবার অধিকাংশ বিচারাধীন মামলার আসামি জামিনে বেরিয়ে পলাতক আছেন। হাজির হচ্ছেন না আদালতে। অনেক মামলার সাক্ষীই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত কর্মকর্তাদের গাফিলতি, তদন্তে বিলম্ব, আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অর্ধেকের বেশি মামলাই অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।
১২ বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী ভিআইপি হাউজিং এলাকায় পাহাড় কেটে প্লট তৈরির অভিযোগে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। সে মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। বিচার শুরু হওয়ার পর গত সাত বছরে এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে হাজির হননি খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরাও। বছরের পর বছর শুধু তারিখই পড়ছে। সরকারি কৌঁসুলি বলছেন, নানা চেষ্টা করেও সাক্ষীদের হাজির করা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আসামিরা খালাস পেতে পারেন।
পরিবেশের সবচেয়ে ঝুঁকির কারণ ইটভাটা। অথচ ঢাকাসহ আশেপাশের পাঁচ জেলায় ৩৯২টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। প্রতিনিয়তই এসব ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তু হচ্ছে ফসলি জমি। গত ১ মার্চ অবৈধ ইটভাটা ১৫ মার্চের মধ্যে গুঁড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কে মানে কার আদেশ! উচ্চ আদালতের কঠোর আদেশের পর ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। ফলে কোনো ধরনের ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই দিব্যি চলছে ইটভাটাগুলো। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশও নাড়াতে পারেনি ভাটা মালিকদের।
এর আগেই কয়েকবার সারা দেশের অবৈধ ভাটা বন্ধে একাধিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে আদালতের আদেশ কাগজে-কলমেই সীমাবন্ধ ছিল। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটা বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় পরিবেশ অধিদপ্তর ‘জেগে ঘুমাচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
এসময় হাইকোর্ট বলেন, সেমিনারে গিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বললেই হবে না। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আদালতের আদেশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে?
আদালত বলেন, বারবার আদেশ দেয়া সত্ত্বেও কেন অবৈধ ইটভাটা বন্ধ হচ্ছে না।
এমন অবস্থায় আইনজ্ঞরা জানান, পরিবেশ আদালতে মামলার ক্ষেত্রে নানা আইনি জটিলতা রয়েছে। একজন ভুক্তভোগী এ আদালতে সরাসরি মামলা করতে পারেন না। তারা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মামলা না করার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি। মামলা না থাকায় পরিবেশ আদালতেরই যেন পরিবেশ নেই। এ আদালতে জনগণের সরাসরি মামলা করার সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবেশের ক্ষতি হয়— এমন অপরাধের বিচার করতে নির্দিষ্ট আদালত থাকলেও ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করা অযৌক্তিক। পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে দূষণ ও দখলকারীদের কঠোর সাজা নিশ্চিতে আগ্রহী নয়। তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে যে জরিমানা করে, তার বড় অংশই আবার আপিল করে ছাড় পান দূষণকারীরা। সব মিলিয়ে দূষণ-দখল পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। পরিবেশ আদালতে অপরাধীদের সাজা হয়। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত আসামিদের তাৎক্ষণিক কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড করায় দিন দিন মামলার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মামলায় কারাদণ্ড কম। বেশিরভাগ মামলায় আদালতে আসামিদের আর্থিক দণ্ড দেয়া হয়। কেউ মামলা করতে চাইলে প্রথমে অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ জানাতে হয়। প্রতিকার না পেলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারেন। পরিবেশ আদালতে মামলা কম হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো সরাসরি মামলার সুযোগ না থাকা। প্রতিটি মামলাতেই বিচার হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু তারিখের পর তারিখ পার হলেও অধিদপ্তর প্রতিবেদন না দেয়ায় মামলার নিষ্পত্তি আর হয় না।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশের তিনটি পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে সাত হাজার ৩০টি। এর মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে দায়ের করা মামলার সংখ্যা মাত্র ৩৮৮, যা মোট মামলার মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ।
ঢাকার পরিবেশ আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মামলায় কারাদণ্ড কম। বেশিরভাগ মামলায় আদালত আসামিদের আর্থিক দণ্ড দিয়েছেন। গত ১০ বছরে নিষ্পন্ন হওয়া ২০০ মামলার মধ্যে ১৪৭টিতে আসামিকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকি মামলায় আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন।
কেবল পরিবেশ আদালতেই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশে যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, সেখানেও অর্থদণ্ড বেশি দেয়া হয়। কারাদণ্ডের মতো সাজা দেয়ার সংখ্যা কম।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশে চার হাজার ৪৪০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কারাদণ্ড দেয়া হয় মাত্র ১৬৬ জনকে।
এদিকে পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়ে এ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হলেও অধিদপ্তরের আগ্রহ বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালতে। পরিবেশ আদালতকে পাশ কাটিয়ে প্রতিনিয়তই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে, হচ্ছে শাস্তি ও জরিমানা। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা করেছে ৮ হাজার ৭৫৬টি। এসময় জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অথচ নির্দিষ্ট আদালত মামলার অভাবে এখন অনেকাংশেই নিষ্ক্রিয়।
ঢাকার পরিবেশ আদালতে কর্মরত সরকার নিযুক্ত কৌঁসুলি (পিপি) ফিরোজুর রহমান বলেন, ‘এখানে বরাবরই মামলা কম আসে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ আদালতে একেবারেই কম মামলা দেয়া হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকে। যে কারণে আদালতে তাদের মামলার সংখ্যা কম।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পর্যাপ্তসংখ্যক পরিবেশ আদালত না থাকায় পরিবেশ দূষণ রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বা মোবাইল কোর্ট অনেক ক্ষেত্রে ভরসা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সেটিও পর্যাপ্ত নয়। কারণ, মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট যে জরিমানা করে, সেটি আপিলে গিয়ে টেকে না। এ জন্য পরিবেশ আদালতে মামলা করার বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে দোষীরা পর্যাপ্ত সাজা পাবে।’
পরিবেশ আইনে জটিলতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবেশ আদালতে জনসাধারণ সরাসরি মামলা করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে অনুমোদনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগকারীকে আবেদন করতে হয়। আইনের এসব শর্ত পূরণ করে কোনো বিচারপ্রার্থী এখানে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।’ তাই জনগণের সরাসরি মামলা করার সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর আদালতপাড়ায় পুরোনো জজকোর্ট বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার ৩১ নম্বর কক্ষে অবস্থিত ঢাকা বিভাগীয় পরিবেশ আদালত।