আউয়াল কমিশনে বড় দুই চাপ। আস্থা ও স্বচ্ছতা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ। ইসির ভাবনার সাথে নির্বাচন পর্যবেক্ষক, গবেষক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের ভাবনা সাংঘর্ষিক। নির্বাচন কমিশন সব রাজনৈতিক দলকে এক টেবিলে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। দ্বাদশ নির্বাচনে ইভিএমে ভোটের কথা বলা হলেও সাড়া মেলেনি।
ইভিএম পদ্ধতিতে আপত্তি দেশের ৯০ শতাংশ রাজনৈতিক দলের। ইভিএম রেষারেষিতে রাজনৈতিক পরিবেশ আরও উত্তেজিত হবে বলেও মনে করছেন অনেকে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, সুস্থ ধারার রাজনীতির প্রয়োজনে সর্বাগ্রে স্বচ্ছ, প্রশ্নমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই ইসির প্রধান দায়বদ্ধতা বলে কথা উঠছে।
সমপ্রতি কুমিল্লা সিটি নির্বাচন ছিল চলমান কমিশনের এসিড টেস্ট। দিনভর শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করলেও শেষ বেলায় ফলাফল ঘোষণাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে মারামারি, ফলাফল স্থগিত ও অজানা ফোনকল নিয়ে রাজনীতির মাঠে প্রশ্ন রয়েছে।
দিনের শান্তির ফল রাতে নষ্ট হওয়ার আস্থার অপূর্ণতা নিয়ে এমন দৃশ্যপটে দ্বাদশে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে নিবন্ধিত দলগুলোর সাথে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। বৈঠকে ইভিএম নিয়ে দলগুলোর মতামত লিপিবদ্ধ করেছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু তাদের দরবারে যায়নি ১১টি রাজনৈতিক দল। তবে ৩৯টি দল সংলাপে সাড়া দেয়।
আওয়ামী লীগসহ মাত্র চারটি রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষ মত দিয়েছে। আর বাকিরা কেউ ইভিএম চায়নি। এ ছাড়া যারা সংলাপে অংশগ্রহণ করেনি তারাও ইভিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তবে নির্বাচন কমিশন শত আসনে ইভিএম ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছে।
এরপর থেকেই নানা মহল থেকেই প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠে আসছে। গত সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ভোট নেয়া হয় এই যন্ত্রে। গত তিন বছরে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও যন্ত্রের মিশিন ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রতিবারই। কখনো আঙ্গুলের ছাপ না মেলা, দীর্ঘ অপেক্ষা, নেটওয়ার্ক না থাকা, অনেক কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রকের অদক্ষসহ নানা বিষয়। আর রাজনৈতিক অনাস্থা তো রয়েছেই।
সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞরা বলছেন, বিএনপি ও সমমনাদের বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা থাকায় আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে আগ থেকেই। এ পরিস্থিতে আউয়াল কমিশনকে ইভিএম বিতর্ক মোকাবিলা করা, রাজনৈতিক আস্থা পূরণ করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছি। এ দুই বিষয়ে চাপ যদি মোকাবিলায় দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাহলে আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে । এখন রাজনৈতিক সমঝোতাই বেশি প্রয়োজন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা আর না বাড়ানোই শ্রেয় বলে দাবি উঠেছে।
সমপ্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ঘোষণা করার পর মাঠে একটা রাজনীতির হাওয়া শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে দেয়, আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো নির্বাচনেই তারা যাবে না; ইভিএম তো পরের বিষয়।
এ পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৯ ও ২১ জুন দুই ধাপে ২৬টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ইভিএম যাচাইয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু দুই ধাপে ১৮টি দল উপস্থিত থাকলেও সাড়া দেয়নি বিএনপিসহ আটটি দল। সব শেষ গত সোমবার তৃতীয় ধাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন। নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র চারটি ছাড়া বাকি ৩৫টি রাজনৈতিক দলই ইভিএমের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন।
এই অনাস্থার প্রশ্ন শুধু রাজনৈতিক দল থেকে নয় সমপ্রতি কমিশনের সাবেক কর্তাদের মুখ থেকেও কথা এসেছে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) এক জায়গায় ত্রুটি আছে। ব্যালট ইউনিটকে টেকনোলজির আওতায় আনা যায়নি। এটা কমপ্লিসিটির (জটিলতার) জন্য।
এখানেও ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নেয়নি মোট ১১টি দল। তারা হলো বিএনপি, সিপিবি, বাসদ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। ইসির আহ্বানে সাড়া গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ।
আবার যারা অংশ নিয়েছে তাদের ৯০ ভাগেরও বেশি ইভিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলের ভাষ্য তুলে ধরে গত ২৮ জুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, অনেক রাজনৈতিক দল (গত দুই সভায়) ইভিএমের বিপক্ষে বলেছে। আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি-না, তা পর্যালোচনা করবে ইসি। ইসির সামর্থ্য কতটা রয়েছে, সেটা দেখা হবে। আদৌ ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি-না বা সম্পূর্ণ কিংবা অর্ধেক আসনে ব্যবহার হবে কি-না, সে বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। তবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিপক্ষেই বেশি কথাবার্তা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের আগে যতটুকু সময় আছে, সে সময়ের মধ্যে যদি রাজনৈতিক দলসহ সবার আস্থা অর্জন করা যায়, তাহলে ম্যাক্সিমাম ১০০ আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট করার পরিকল্পনা রয়েছে। আস্থা তৈরি ও বাজেটের বিষয়টি মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো বাংলাদেশেও আস্থা অর্জন হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। রাজনীতিসহ চলমান ইভিএম ইস্যুতে প্রশ্ন সাধারণ মানুষেরও।
রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় একটি ব্যাংকে চাকরি করেন আলফাজ আলী। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যে যেটাই বলুক না কেন আওয়ামী লীগ যেটা বলবে সেটাই হবে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব তাদের দলের পক্ষ থেকে ইভিএমে ভোট করার কথা বলেই দিয়েছেন। অতএব এটাই ফাইনাল। বাংলাদেশে বর্তমানে যতগুলো আছে তারা এক হয়ে ব্যালট পেপারে ভোটের কথা বললেও তা হবে না।
যেমন কেয়ারটেকার পদ্ধতিতে নির্বাচন করার বিষয়ে সরকার পক্ষ থেকে এমিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়ার পর তারা সবাই কেয়ারটেকার পদ্ধতি সমর্থন জানালেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা নাকচ করা হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।’ তাই এত টালবাহানা করে কোনো লাভ নেই, দিন শেষে ক্ষমতাশালী দল যা বলবে হয়তো নির্বাচন কমিশনকে তাই করতে হবে বলেও অভিযোগ এ ব্যক্তির।
আগামী নির্বাচন ইভিএমে হোক তা জাতীয় পার্টি চায় না বলে জানান দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ধারণা হলো— ইভিএম মানে এর মধ্যে অন্য কোনো কারসাজি আছে। ইভিএম মানে বিশেষ দল কিছু করতে পারে। ইভিএমের দোষের চেয়ে বড় হলো দেশের ভোটাররা ইভিএমে ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। ইভিএম মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।’
জেএসডির সভাপতি আসম আব্দুর রব নির্বাচনের ইভিএম ব্যবহারকে সরকারের দুরভিসন্ধি হিসেবে মনে করেছেন। তিনি বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া নয় বরং ক্ষমতা ধরে রাখা সরকারের নতুন ফন্দি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত রাষ্ট্রকে নতুন করে বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত করবে। শুধু ক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকার উম্মাদনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ভোট গ্রহণে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) নেতারা। ইভিএম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোট চুরির বিশ্বস্ত যন্ত্র বলেও উল্লেখ করেন তারা।
দলটির মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বলেন, ইভিএমে ভোট হবে, এটি এখনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। বরং দেশের পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাই ভেঙে গেছে। নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই নির্বাচন কমিশনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। অনেক দেশ ইভিএম থেকে সরে এসেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে কাগজের ব্যালটে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করাই সর্বোত্তম। নির্বাচন কমিশনকে নতুন বিতর্কে জড়ানো সমীচীন হবে না বলে মনে করি।’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল পরিষ্কার করে গণমাধ্য ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ইভিএম তো পরের কথা, শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে বিএনপি নির্বাচনেই যাবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘ছোট পরিসরের নির্বাচনে ইভিএম যৌক্তিক হতে পারে, কিন্তু সংসদ নির্বাচনের মতো ক্ষমতা বদলের নির্বাচনে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি কমিশন নির্বাচন।
এছাড়া খোদ ইভিএম উদ্ভাবনকারী দেশগুলোও এই প্রযুক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক সমঝোতা অনেক বেশি প্রয়োজন।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেছেন, ‘ইভিএমে ভোট গ্রহণ কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা যে নয় তা ইতোমধ্যে দেশে কমবেশি প্রমাণিত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও এ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল এবং তারা সেখান থেকে সরে এসেছে। অনেক অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিদায়ী নির্বাচন কমিশন ইভিএমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোট গ্রহণ করে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। খোদ কমিশনের ভেতরেও এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য শোনা গিয়েছিল।
ইভিএম নিয়ে ফের বিতর্কের ক্ষেত্র সৃষ্টি না করে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন তাদের সহযোগী শক্তি সরকারের উচিত রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচন নিয়ে যে সন্দেহ কিংবা আস্থাহীনতা রয়েছে, তা দূর করা। ইভিএম পদ্ধতি আমাদের বাস্তবতায় আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য যে প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ জনবল দরকার তা তো নেই-ই; প্রাতিষ্ঠানিক আরও নানা দিকেই এ ব্যাপারে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তাই এ পথে পা না বাড়িয়ে রাজনৈতিক জটিলতা আর না বাড়ানোই শ্রেয়।’