বেহাল দশায় দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বছর বছর বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা, চালু হচ্ছে নতুন নতুন বিভাগ। অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে অদক্ষ শিক্ষকের সংখ্যাও। সব কিছু বাড়লেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ গবেষণা করা হলেও গবেষণাশূন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয় যেন সনদ বিক্রির বৈধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র গবেষণা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলেই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পরিচালিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা বন্ধে হিমশিম খাচ্ছে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক গবেষণা নিয়ে ইউজিসির বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা আমলে নিচ্ছে না এসব উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র যে গবেষণা করছে সেসবের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ শিক্ষাবর্ষে গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি এমন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সংখ্যা ১৮টি। গবেষণায় মাত্র পাঁচ লাখ টাকার কম বরাদ্দ দিয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সংখ্যা ১০টি।
এছাড়া গবেষণা বৃত্তি ও গবেষণায় বরাদ্দ থাকলেও কোনো ধরনের গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়নি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও অজস্র। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে গবেষণার প্রবণতা বাড়ার বদলে গবেষণার সংখ্যা দিন দিন কমছে। মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার জন্য গবেষণায় বরাদ্দ নেই বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ থাকলেও আবার নেই কাঙ্ক্ষিত মানের গবেষণা।
ফলে সামপ্রতিক সময়ে বিশ্বে বাংলাদেশ দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকা ও অতিমাত্রার বাণিজ্যিক মানসিকতার রোষানলে অনেক শিক্ষকও গবেষণার প্রতি অনীহা প্রকাশ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্য করতে হবে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে। যাতে মেধাবীরা গবেষণার জন্য বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা শেষে দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আগ্রহী হন। এ জন্য প্রয়োজন তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে রাখার উদ্যোগ নেয়া। ইউজিসিকেও গবেষণার বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে, যাতে কেউ গবেষণা কার্যক্রমে উদাসীন থাকার অবকাশ না পায়।
এদিকে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়, সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যেখানে ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত।
সুতরাং শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন গতিশীল করতে গবেষণার বিকল্প নেই বলে মত বিশেষজ্ঞদের। যেহেতু দেশের মোট শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত সেহেতু দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষাতেও গবেষণায় বরাদ্দ রাখা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ শিক্ষাবর্ষে গবেষণা খাতে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি, দ্য পিপল’স ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, জেডএইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স, রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, রুপায়ন এ কে এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়, আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি, জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিট, ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারেক আহসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখলেই যে গবেষণা হবে বিষয়টি এমন নয়। গবেষণার জন্য একটি সংস্কৃতি বা পরিবেশ তৈরি করাটা খুব জরুরি। গবেষণার সাথে ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের পদোন্নতির সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। এছাড়া দেশীয় বা আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে প্রকাশনার সাথে তাদের একটি যোগসূত্র নিশ্চিত করতে হবে।
এ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের যে পলিসি তৈরি হয় সেখানে গবেষণা নির্ভরতা থাকতে হবে। এত করে গবেষণার গুরুত্বের পাশাপাশি শিক্ষকরাও গবেষণার প্রতি আগ্রহী হবেন।’
তিনি বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন মানুষ মনে করে, ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য গবেষণা দরকার; তেমনি একটি রাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও গবেষণার বিকল্প নেই। সুতরাং ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রের গবেষণা নির্ভরতার মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে গবেষণার সংস্কৃতি গতে তুলতে হবে। তা না হলে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিয়েও গবেষণা হবে না। গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান সৃষ্টির বিপরীতে সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে রূপ নিচ্ছে।’
এ বিষয়ে ইউজিসির পোস্ট ডক্টরাল ফেলো অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস আমার সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন, যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন ও নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। গবেষণা করার ব্যাপারে অনেক শিক্ষকের উদ্যোগের অভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। নতুন জ্ঞানার্জনের জন্য গবেষণা পরিচালনা করা উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম মূল কাজ। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে গবেষণা কাজ চালাচ্ছে তা যথেষ্ট নয়।’
তিনি বলেন, ‘হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক-তৃতীয়াংশই নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করে। এগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই নামকাওয়াস্তে গবেষণা খাতে খরচ দেখায়। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান গবেষণা নিয়ে চিন্তা করে না। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।’
জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম আমার সংবাদকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যে নীতিমালা আছে তা পর্যাপ্ত নয়। নীতিমালায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার জন্য বলা হলেও কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা নেই। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এর পরিবর্তন জরুরি।
নতুন আইনে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও গবেষণার জন্য একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু আমরা অর্থায়ন করি সেহেতু তাদের তদারকি ও জবাদিহি করা অপেক্ষাকৃত সহজ।
অপরদিকে, আইনগত জটিলতা ও গবেষণায় ফান্ড না দেয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তদারকি করা ও জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সুতরাং সামগ্রিক এ সমস্যা নিরসনে আগে আইনের পরিবর্তন আনতে হবে।’