চরমোনাইপন্থী ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মসজিদ দখলের অভিযোগ

ইসরাফিল ফরাজী প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২, ০১:১২ পিএম
চরমোনাইপন্থী ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মসজিদ দখলের অভিযোগ

রাজধানীর মাতুয়াইলে নিউটাউন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ দখলের অভিযোগ উঠেছে চরমোনাইপন্থী বরিশাল সদর উপজেলার জাগুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইসলামিক বক্তা মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ আজাদীর বিরুদ্ধে। খতিব নিয়োগ পরীক্ষায় ততকালীন সময় বাদ পরার পর খতিব হয়ে নামাজ পড়াতে আসার কারণে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে মুসল্লিদের মাঝে। স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকায় কমিটির পুনর্গঠন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বর্তমান সভাপতি ও স্থানীয় মুসল্লিরা।

জানা যায়, রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার নিউটাউন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দীর্ঘদিন জুমার নামাজ পড়াতেন জনপ্রিয় ইসলামিক বক্তা আবুল কালাম আজাদ বাশার। 

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে সাধারণ জনগণ ও স্থানীয় মুসল্লিরা অভিযোগ করেছেন, শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) নামাজের আগে কওমি মাদ্রাসার কয়েকশ ছাত্র নিয়ে অবৈধভাবে মসজিদ দখল করেছে চরমোনাইপন্থী ইউ পি চেয়ারম্যান হেদায়াতুল্লাহ আজাদী। 

এ ব্যাপারে মসজিদের বর্তমান খতিব আবুল কালাম আজাদ বাশারের সাথে কথা হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, বিষয়টি গণমাধ্যমে আসুক তা আমি চাই না। তবে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা মসজিদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিষয়টি নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। আশা করছি দ্রুতই স্থানীয় প্রশাসন ও কমিটির ব্যক্তিরা সমাধান করবেন।  

এদিকে এই ঘটনার পর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘পীর সাহেবের নিজস্ব লোকেরা কওমী মাদরাসার ২/৩ শত ছাত্র নিয়ে জুমা`আর এক ঘণ্টা পূর্বে হঠাৎ করে মাসজিদ দখল করে নেয়। আগামী শুক্রবার পর্যন্ত দেখে এ ফ্যাসিবাদ নিয়ে জাতিকে বিস্তারিত জানাবো, ইনশাআল্লাহ।’

তার এই লেখা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে কমিটির সাথে আলোচনা করে রোববার রাতে পোস্টটি মুছে সরিয়ে ফেলেন তিনি।

এবিষয়ে, মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ আজাদীর ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বার ০১৯১৬....১৯৭ নাম্বারে কল দিলে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি ফোন কেটে দেন। 

পরবর্তীতে তার সফর সঙ্গী নরুল হুদা সাব্বির কল রিসিভ করলে মসজিদ দখলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, হুজুর বিষয়টা জানতেন না। মসজিদ কমিটির দাওয়াতে মূলত সেখানে জুম‍ার নামাজ পড়াতে এবং বয়ান করতে যান। এরকম কিছু হবে জানলে আজাদী সাহেব সেখানে যেতেন না।

হেদায়াতুল্লাহ আজাদীর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, বাদ আসর হুজুর লাইভে আসবেন এবং বিষয়টি সম্পর্কে জানাবেন তখন সকলে জানতে পারবেন। পরবর্তীতে আসর নামাজের পর লাইভে না আসায় ফের যোগাযোগ করা হলে সাব্বির বলেন, বাদ মাগরিব হুজুর লাইভে আসবেন।

পরবর্তীতে রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় মসজিদের বিদ্রোহী কমিটির একাংশের সংখ্যালঘু সদস্যদের নিয়ে লাইভে এসে মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ বলেন, সিরাজুল ইসলাম আকন ভাইয়ের ফোনে আমি নিউটাউন কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ পড়াতে যাই। আমি ওখানে গিয়েছি মূলত নামাজ পড়ানোর জন্য। 

তিনি বলেন, আমি আবুল কালাম আজাদ বাশার ভাইয়ের সাথে মোবাইলে কথা বলেছি এই বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আমি মূলত অস্থায়ী খতিব হিসেবেই ওখানে গিয়েছি। স্থায়ীভাবে আমি খতিব হওয়ার জন্য নয়। আমি এখানে একাই গিয়েছিলাম অন্য কাউকেই সাথে নিয়ে যাইনি।  আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে ছাত্রদের নিয়ে আসা বা মোটরসাইকেল যোগে অনেককে নিয়ে আসা এটা সত্য নয়। যারা আসছে তারা মূলত আমার বয়ান শুনতে এসেছে। আমি বর্তমানে যেখানে নামাজ পড়াই সেখানেই থাকবো।  

এবিষয়ে নিউটাউন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি নেসার উদ্দীনের সাথে কথা হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ কোন সমস্যা ছাড়াই আবুল কালাম আজাদ বাশার সাহেব নামাজ পড়াচ্ছেন এতদিন কোন বিরোধ ছিলো না। হঠাৎ করে একটা পক্ষের কি হলো তা আমার জানা নেই। 

গত ৯ সেপ্টেম্বর আমাদেরই কমিটির সহ-সেক্রেটারী মো: আবুল কাশেম কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কথা বলে মোহাম্মাদ নাজমুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে মসজিদ কমিটি ঘোষণা করে, যার কোন ভিত্তিই নেই। তার কাছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সেই কাগজ দেখতে চাইলে এখন পর্যন্ত কোন কাগজ দেখাতে পারেনি। 

এই বিষয়ে মসজিদের মোতওয়াল্লীদের নিয়ে আমরা ১৪ সেপ্টেম্বর একটি মিটিং ডাকি তখন অবৈধভাবে কমিটি গঠনকারী বর্তমান বৈধ কমিটির সহকারী সেক্রেটারী আবুল কাশেমকে চিঠির মাধ্যমে দাওয়াত দিলে সে চিঠি গ্রহণ না করে খারাপ ব্যবহার করেন। যার কারণে মিটিং করা সম্ভব হয়নি।   

তিনি বলেন, এই বিষয়ে একটি বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা দেখা দিলে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শফিকুর রহমান (পিপিএম) আমাদের ডাকেন সে সময় আমি থানায় উপস্থিত হলে অবৈধভাবে কমিটি ঘোষণাকারীরা কেউ না এসে তাদের প্রতিনিধি পাঠায় যারা মসাজিদের সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয়। 

পরবর্তীতে ওসি সাহেবের সাথে কথা বলে আমি রাত ১২ টায় চলে আসি। সকালে থানার এসআই মাজহার আমাকে ফোন করে জানান, বর্তমান খতিব আবুল কালাম আজাদ বাশারকে যেন আমি না করি শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) মসজিদে আসতে। তিনি আসলে সংঘর্ষ হতে পারে। তার কথা অনুযায়ি আমি বাশার সাহেবকে আসতে না করি। 

শুক্রবার নামাজ শুরুর আগেই কওমি মাদ্রাসার ছেলেরা এসে মসজিদ প্রায় দখল করে নেন। তার কিছুক্ষণ পরই মসজিদে নামাজ পড়াতে আসেন মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ আজাদী। তিনি এর আগেও আমাদের মসজিদে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন। সে সময় সকলের মতামতের উপর ভিত্তি করে আমরা যাচাই বাছাই করে তাকে বাদ দিয়ে বাশার সাহেবকে খতিব হিসাবে নিয়োগ দেই। সে থেকেই বাশার সাহেব মসজিদে খতিব হিসেবে আছেন। বাশার সাহেব কোন গল্প কাহিনী করেন না কুরআন থেকে সরাসরি তাফসির করেন।

নেসার উদ্দীন বলেন, আমি এই এলাকার ৩ টা মসজিদের সভাপতির দায়িত্বে আছি। আমি কোন অবৈধ কাজ করলে আমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হতো না। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করছে তারা কেউ কমিটির সক্রিয় সদস্য নয়। মসজিদের জমি ক্রয় নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারীর প্রমাণ রয়েছে। সে টাকা ফেরত না দেওয়ার জন্যই এখন একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে।

তিনি বলেন, আমি নিজের ইচ্ছায় সভাপতি হয়েছি বিষয়টা এমন নয়। মসজিদে প্রায় ১০৭ জন মোতওয়াল্লী রয়েছেন তাদের সিদ্ধান্তেই একটি কমিটি হয়েছে এবং আমি প্রথম থেকেই সভাপতির দায়িত্বে আছি।

আবুল কাশেম যে কমিটি ঘোষণা করেছিলেন তার আহ্বায়ক ছিলেন মোহাম্মাদ নাজমুল ইসলামকে। তবে এই বিষয়ে মোহাম্মদ নাজমুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার সাথে কোন প্রকার আলোচনা না করেই তারা আমাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি ঘোষণা করেছে।  আমি তাদের সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি।

মসজিদের সহ-সেক্রেটারী আবুল কাশেমের সাথে যোগোযোগ করা হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, সভাপতি তার নিজের একক আধিপত্য বিস্তার করে মসজিদ কমিটি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা চালিয়েছে। একটি বিশৃঙ্খলা দেখে সংবিধান অনুযায়ী আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন জানিয়েছি সেখান থেকে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেহেতু স্থানীয় প্রশাসন এই বিষয়ে সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে তাই আমরা ওই কমিটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। এখন ডেমরা থানার ওসি মহোদয় যে সিদ্ধান্ত দিবেন আমরা সেটাই মেনে নিব। 

মোহাম্মাদ নাজমুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি নিজেই জানে না এবিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কাশেম বলেন, তাকে ভয় ভিতি দেখানো হয়েছে সম্ভবত তাই তিনি অস্বীকার করেছেন।  

এ বিষয়ে নিউটাউন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম আকন বলেন, বর্তমানে মসজিদ কমিটি ২ ভাগে বিভক্ত সভাপতির একক সিদ্ধান্ত ও মসজিদের হিসাব না দেওয়া থেকে শুরু করে অনেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে, সে অভিযোগ থানায় পর্যন্ত চলে যায়, সেখানে খতিব নিয়েও আলোচনা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে ওসি থানায় ডেকে বলেন, কাল আমি জুমার নামাজ পড়বো আপনাদের মসজিদে এবং খতিব সাহেবকে আসতে নিষেধ করবেন, কালকের জন্য ভালো কাউকে দিয়ে নামাজ পড়াবেন, তাই আমি আজাদী সাহেবকে নমাজ পড়াতে আসতে বলি। আজাদী আমার আপন ছোট ভাইয়ের মতো আবার খুব ভালো বন্ধুও তাই সে আমার দাবি রাখতে সেদিন জুমার নামাজ পড়াতে এসেছিলেন। মসজিদ দখল করার জন্য নয়।  

তিনি বলেন, মসজিদ কমিটির সহকারী সেক্রেটারী আবুল কাশেম সাহেব দীর্ঘদিন চলতে থাকা সমস্যা দেখায় তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটির অনুমোদন নেয়। যেখানে কমিটির অন্যান্য সদস্য এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকদের স্বাক্ষর রয়েছে। 

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সে কাগজ কোথায় আছে জানতে চাইলে আকন বলেন, সেই কাগজ কাশেম সাহেবের কাছেই আছে। সেটা তার কাছ থেকেই দেখে নিতে হবে। তবে এই কাগজের এখন আর ভ্যালু নেই কারণ কমিটির সভাপতি নেসার সাহেব এই বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছে।

থানায় অভিযোগ করলে কমিটি বাতিল হয়ে যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আকন বলেন, কমিটি বাতিল হয় না কিন্তু সে অভিযোগ করেছে এবং থানা থেকেও কমিটি পুনর্গঠনের কথা বলেছে। তাই ওই কমিটির এখন আর কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।   

তিনি বলেন, ওসি সাহেব একটা সমাধানের কথা বলেছেন। ৫ সদস্যের একটি কমিটি পুনর্গঠন করে খতিবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন। আমরা ১০ সদস্যের কমিটির জন্য আবেদন করেছি। এই কমিটি গঠনের পর যেই সিদ্ধান্ত আসবে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। সিদ্ধান্তে যদি বর্তমান খতিব আবুল কালাম আজাদ বাশার সাহেব পুনরায় নিয়োগ পায় তাহলে আমরা তা গ্রহণ করবো এবং তার পিছনেই নামাজ পড়বো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউটাউন এলাকার একজন মুসল্লি বলেন, এই রকম মৌলভী চেয়ারম্যান দিয়ে মসজিদ মাদরাসা দখল করা যাবে, কিন্তু হেদায়েত লাভ করা যাবে না।  এখানে কাশেম সাহেব একটি মাদরাসা তৈরি করেছে। সেই মাদরাসার অভন্তরিন কোন্দল থেকেই তিনি মসজিদে একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন। এতে করে আমাদের এলাকার সম্মানহানী হচ্ছে। শুনেছি জুমার নামাজ পড়াতে আসা মাওলানা তিনি নিজেও এক সময় নারিন্দা বিনত বিবি জামে মসজিদ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। এরপর রাজধানী মার্কেট মসজিদ থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন।  

নাজমুল হক নামের এক মুসল্লি বলেন, একজন আলেম হয়ে তিনি দখলের রাজনীতিতে কেন নামলেন? তার হাত থেকে কি মসজিদ মাদরাসাও নিরাপদ থাকবেনা? 

এবিষয়ে ডেমরা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শফিকুর রহমান (পিপিএম) আমার সংবাদকে বলেন, ওই মসজিদে ২ টা কমিটি তৈরি হয়ে একটি হট্টগোল তৈরি হয়েছিলো তাই উভয় পক্ষকে আমি বলেছিলাম নিরপেক্ষ একজন মাওলানা দিয়ে জুমার নামাজ পড়ানোর জন্য। 

এখানে কে কোন দল করেন তা আমি জানি না। এখন তারা যদি চরমোনাইয়ের/অন্যকোন রাজনৈতিক লোক দিয়ে নামাজ পড়ায় তাহলে সেটা আমি কিভাবে জানবো। আমরা চেষ্টা করছি এটা সমাধান করার জন্য।

মসজিদে আমি অস্থায়ী একটি কমিটি তৈরি করে দিয়েছি অল্প সময়ের মধ্যেই এটা সমাধান হবে। এবং তারা মিলে নতুন করে একজনকে নিয়োগ দিবে।      

টিএইচ