চাঁদপুর-৪

নির্বাচনি ট্র্যাজেডি: রাজা থেকে ভূঁইয়া

আতাউর রহমান সোহাগ, ঢাকা প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪, ০৮:২৮ পিএম
নির্বাচনি ট্র্যাজেডি: রাজা থেকে ভূঁইয়া
রাজা মিয়া (বামে) ও ড. শামছুল হক ভূঁইয়া (ডানে)। ছবি: ফাইল

১৯৮৬ সালের ৭ মে ছিল তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। নির্বাচনে তৎকালীন চাঁদপুর-৬ আসনে (বর্তমান চাঁদপুর-৪) আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতিকের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সাবেক গণপরিষদ সদস্য রাজা মিয়া। নির্বাচনে কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে ৪৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩২টিতে এগিয়ে ছিলেন তিনি। তবে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফলে নির্বাচনে জয় লাভ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাওলানা আব্দুল মান্নান। নির্বাচনের পর রাজা মিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। নির্বাচনের পর তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র ২৭ দিন।  ১৯৮৬ সালের ৪ জুন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান সবার প্রিয় রাজা মিয়া স্যার।

তাঁর পরিবারের সদস্যদের দাবি, ভোটে জিতলেও ফলাফল ঘোষণার সময় তাকে হারিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তিনি একদম মেনে নিতে পারেন নি। মনের কষ্টে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি।

দীর্ঘ ৩৮ বছর পর আবারও চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। নির্বাচনের ২৬ দিন পর মারা গেলেন সাবেক সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৩ ও ৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। চাঁদপুর-৪ আসনের ১১৮টি কেন্দ্রের ফলাফলে তিনি ৬৪টিতে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি নৌকা প্রতিকের প্রার্থী মুহম্মদ শফিকুর রহমান এগিয়ে ছিলেন ৪৭ কেন্দ্রে। তবে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফলে সাংবাদিক শফিকুর রহমান এক হাজার ৩৩ ভোটে এগিয়ে থেকে জয় লাভ করেন। এ নির্বাচনের পর পাহাড়সম দুঃখ নিয়ে রাজনীতিতে প্রবল শক্তিশালী মানুষটি গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন। নির্বাচনের এ ফলাফল তিনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন নি।

ফলাফল ঘোষণার পর গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে। অসুস্থ শামছুল হক ভূঁইয়া চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে। সেখানে সিসিইউ-আইসিউতে ভর্তি ছিলেন তিনি। ব্লাড ক্যান্সারের জন্য তাঁকে দেওয়া হচ্ছিল কেমো থেরাপি। তবে গত ২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে হাজারো নেতাকর্মীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রিয় ভূঁইয়া ভাই।

ফরিদগঞ্জ এআর পাইলট সরকারি স্কুল মাঠে জানাযা নামাজে উপস্থিত মুসল্লিদের একাংশ। ছবি: আমার সংবাদ

এদিকে চাঁদপুর-৪ ফরিদগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়ার মৃত্যুর পর নেটিজনেরা অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। অনেকেই লিখেছেন নির্বাচনের শোকে তিনি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় হয়ে গেছেন।
এ নিয়ে কথা হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, ড. শামছুল হক ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহম্মেদ ভুঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ১২ বছর সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ড. শামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় সংগঠক। দলের প্রতি আনুগত্যশীল।

ড. শামছুল হক ভুঁইয়ার দুটি আসনে প্রার্থীতার বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে তিনি চাঁদপুর-৩ ও ৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মূলত সরকারের উচ্চমহলের নির্দেশ এবং পরামর্শে তিনি দুটি আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। আর ফরিদগঞ্জে নির্বাচনের ফলাফলে তিনি জয় লাভ করেছিলেন ৩৬৪ ভোটে। তবে নির্বাচনের ফলাফলে তাকে এক হাজার ৩৩ ভোটে পরাজিত দেখানো হয়। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফল ড. শামছুল হক ভূঁইয়া কোনভাবে মেনে নিতে পারেন নি বলে আমি মনে করি। এরকম একটি নির্বাচনের কারণে আমরা হারালাম চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের লাখো নেতাকর্মীর আশ্রয়স্থল একজন জনপ্রিয় নেতাকে।

এদিকে ৬ দফা জানাজা শেষে ড. শামছুল হক ভূঁইয়াকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ফরিদগঞ্জের কাওনিয়া গ্রামে মা-বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। প্রতিটি জানাজায় দলমত নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। 

১৯৮৬ সালে নির্বাচনের পর পিতার মৃত্যুর বিষয়ে কথা হয় রাজা মিয়ার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আলিম আজম রেজার সঙ্গে। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর আমার বাবাকে ফরিদগঞ্জ নিয়ে নির্যাতন চালায় এরশাদের সেনাবাহিনী। এছাড়া ৪৮ কেন্দ্রের ফলাফলের মধ্যে ৩২ কেন্দ্রে এগিয়ে থাকার পরও আমার বাবাকে পরাজিত দেখানো হয়। নির্বাচন পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

রেজা আরও বলেন, আমার বাবা ৭০’র নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে জয় লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কড়ইতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এছাড়া তিনি তৎকালীন পাইকপাড়া ইউনিয়ন (বর্তমান ৭, ৮ নং পাইকপাড়া উত্তর ও দক্ষিন) এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরী। ছবি: সংগ্রহিত

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে তৎকালীন চাঁদপুর-৬ আসনে (বর্তমানে চাঁদপুর-৪) বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আলমগীর হায়দার খাঁন ৩৭ হাজার ৬৬১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তখন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি ও চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরী নৌকা প্রতিকে নির্বাচন করেন।

নির্বাচনে তিনি পেয়েছিলেন ২৭ হাজার ৩১৪। তবে ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলেন জাকারিয়া চৌধুরী। ফলাফল মেনে নিতে না পারেন নি তিনিও। অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে জাকারিয়া চৌধুরীকে উপরে উল্লেখিত দুই নেতার ভাগ্যবরণ করতে হয়নি। তিনি বেঁচে ছিলেন। তবে তাকে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়েছে। ২০০৪ সালে ভারতের নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

এআরএস