জাতির পিতার স্মৃতিধন্য দেশের বীমা খাতকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে প্রধানমন্ত্রী যখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সে সময় এই খাতের কয়েকজন অসাধু পরিচালকের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এই মহতী উদ্যোগ। দেশের প্রচলিত আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই পরিচালকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কায়েম করছেন নিজস্ব কানুন। এ জন্য প্রথমেই প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের কব্জায় নিতে গড়ে তুলছেন পারিবারিক সিন্ডিকেট।
এরপর ঝেঁটিয়ে বিদায় করছেন নীতি-নৈতিকতা ও আইন-কানুন। পুঁজিবাজারভুক্ত বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নিয়েও এমনই অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির বিধিবদ্ধ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এ হক অ্যান্ড কোং ও রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোম্পানির যোগসাজশ থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করেছে সূত্রটি। ফলে বিষয়টি নিয়ে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে খাত সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালে মোট ব্যবসা করেছে ৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু প্রিমিয়াম ও অন্যান্য আয়সহ মোট সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ৬২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির মোট ব্যবসার মধ্যে বকেয়া রয়েছে ২৪ কোটি টাকা। বীমা আইনে নিষিদ্ধ করার পরও প্রতিষ্ঠানটি বাকিতে ব্যবসা করার রেওয়াজ বজায় রেখেছে।
অথচ নন-লাইফে প্রিমিয়াম গ্রহণ ছাড়া ব্যবসা না করার বিষয়ে আইনে উল্লেখ রয়েছে। উপরন্তু এ নিয়ে একাধিক সার্কুলার জারি করেছে আইডিআরএ। এরপরও এই আইন বা নির্দেশনার প্রতি কোনো তোয়াক্কা করেনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স। মূলত প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত থাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন ব্যবসা দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন এক বিনিয়োগকারী।
অপরদিকে ব্যবস্থাপনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেনা পরিশোধ না অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের (এসবিসি) পাওনা পরিশোধ করছে না। ফলে প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে দেনার পরিমাণ। বিগত ২০২০ সালে এসবিসির কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যে এই দেনা বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য এসবিসির কাছে প্রতিষ্ঠানটির সরকারি ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত প্রিমিয়ামের ৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা সমন্বয় করার পরও প্রায় ২১ কোটি টাকা বকেয়া থাকে। এ ছাড়া বিবিধ দেনাদার (সানড্রি ক্রেডিটরস) ২০২০ সালের ২৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭ কোটি ২৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বীমা কোম্পানির পরিচালক হতে ১০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হলেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক তাসনিম বিনতে মোস্তফার এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি। এই পরিচালক সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ১৯৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। সে হিসাবে বর্তমানে তার বয়স ২৪ বছর চার মাসের কিছু বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫ সালের তথ্য থেকে দেখা যায় তিনি ওই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে ছিলেন। সে সময় পরিচালক হতে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হলে তাকে ২০০৫ সাল থেকে কর্মঅভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ ২০০৫ সালে তার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। এই বয়সে স্বাভাবিকভাবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যোগ্যতা থাকতে পারে না।
যদি ২০১৫ সাল থেকে তার কর্মঅভিজ্ঞতা ধরা হয় তবে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার অভিজ্ঞতার সময়সীমা সাত বছর। অর্থাৎ কোনো দিক দিয়েই তিনি পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। তাই ২০১৫ সাল থেকে তার ভোটাধিকার ক্ষমতা এবং বৈঠক ফি বাবদ নেয়া সম্মানি দুটোই অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে।
এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এজিএমে অনুমোদন ছাড়াই তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিয়েছেন। অথচ নিয়মানুসারে স্বতন্ত্র পরিচালকরা শুধু বোর্ড ফি ও অন্যান্য পরিচালক বোর্ড ফির পাশাপাশি মুনাফা ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, শুধু স্বতন্ত্র পরিচালকরাই নয়, উদ্যোক্তা পরিচালকরাও নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন কোম্পানি থেকে।
এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি বিএসইসির কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড ভঙ্গ করেছে। এত সব অনিয়মের পরও কোনো শাস্তি বা জবাবদিহিতার কবলে না পড়ায়, প্রতিষ্ঠানটির ‘পরিবারতন্ত্র’কে দায়ী করছেন খাত বিশ্লেষকরা।
এটিকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উল্লেখ করে তারা বলেন, বীমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা ২০১৩ এর ৩(২)(খ) ধারা অনুসারে ফরম বিউনিক-খ এর ক্রমিক ১৮ তে বলা হয়েছে— কোনো বীমাকারীর পরিচালক পদে থাকার অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন, যদি তার নিজ পরিবারে পরিচালক দুই এর অধিক হয়।
তা ছাড়া এক পরিবার থেকে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করলে তাও পরিচালক পদে থাকার অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে একই পরিবার থেকে ছয়জন পরিচালক রয়েছেন। এরা হলেন, চেয়ারম্যান নিজে, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে।
সম্মিলিতভাবে তাদের শেয়ার ধারণের হার ৩৪.১৭ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের অনিয়ম করার পরও অভ্যন্তরীণ বা বহিঃনিরীক্ষকরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। এমনকি অনিয়মের পরও ‘কোয়ালিফাইড’ অপিনিয়ন না দেয়ার বিষয়ে উভয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু বিষয় জানার পর প্রত্যেকেই ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে গেছেন। এতে নিরীক্ষকরাও প্রতিষ্ঠানটির কাছে ‘ম্যানেজ’ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে জানতে বাংলাদেশন ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের সিইও এবং কোম্পানি সচিবকে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তারা রিসিভ না করায় পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়া হয়। কিন্তু মেসেজ দেখার পরও তারা কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি।