স্বাস্থ্য ক্যাডারে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। চাকরির সব শর্ত পূরণ করেও অন্যান্য ক্যাডারে যথাসময়ে পদোন্নতি হলেও একই শর্ত পূরণ করে, এমনকি বাড়তি যোগ্যতা নিয়েও পদোন্নতিতে বৈষম্যের শিকার হতে হয় স্বাস্থ্য ক্যাডারের বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে।
এছাড়া পদ সংকটসহ নানান জটিলতায় জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতা থাকার পরও যথাসময়ে পদোন্নতি না পাওয়ায় চিকিৎসকদের মধ্যে দানা বাঁধছে অসন্তোষ। পদোন্নতি জটিলতায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকেই, কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছেন জালিয়াতিতেও।
যে কারণে পদোন্নতি সংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতেও উল্লেখ করা হয়— এইচআরআইএস-প্রোফাইলে মিথ্যা তথ্য দিলে আবেদন সরাসরি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অতীতে পদোন্নতিতে বৈষম্য ও জালিয়াতির একাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
পদোন্নতির ক্ষেত্রে এমন টানাপড়েনে পেশাগত মর্যাদার প্রশ্নে অবসরে চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনাও করছেন কেউ কেউ। তবে টানাপড়েন মেনেও যারা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই হারাচ্ছেন স্বাভাবিক কর্মগতি। বর্তমানে স্বাস্থ্য সার্ভিসের সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে।
চলতি বছরের মার্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পদোন্নতিতে আগ্রহী চিকিৎসকদের এপ্রিল নাগাদ বেঁধে দেয়া সময়ে আবেদন করতে বলা হয়। অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আবেদনের সময় শেষ হয়েছে, এখন যাচাই-বাছাই চলছে। আবেদন করা চিকিৎসকরা বলছেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে এবারও যেন অতীতের মতো বৈষম্যের ঘটনা না ঘটে। যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই এবার পদোন্নতি দেয়া হবে —এমনটাও আশা করছেন তারা।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য ক্যাডারে (মেডিসিন) সর্বশেষ বিভাগীয় পদোন্নতি দেয়া হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। ওই সময় সহকারী অধ্যাপক থেকে ৪৪ জন চিকিৎসক সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতি পান। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সে সময় করা তালিকার প্রথম ৩৫ জনের মধ্যে মাত্র দু’জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়।
সর্বমোট পদোন্নতিপ্রত্যাশী ছিলেন ১০৭ জন। এর মধ্যে তালিকার সর্বশেষে থাকা ব্যক্তি পদোন্নতি পেলেও জ্যেষ্ঠতার প্রথম দিকে থাকাদের ভাগ্যে পদোন্নতি জোটেনি। এ নিয়ে চিকিৎসকরা জানান, দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়ায় পদোন্নতির সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছেন অনেকেই। পরবর্তীতে প্রায় পাঁচ বছর চলে গেলেও বলার মতো আর কোনো বিভাগীয় পদোন্নতি হয়নি।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) সাবিনা ইয়াসমিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমি আসার পর পদোন্নতি হয়নি— এটা জানি। এর আগে যদি হয়ে থাকে আমার কাছে সে তথ্য নেই। এটি ডিজি অফিস জানে।’ এ ছাড়াও মেডিসিন বিভাগের মতো অন্যান্য বিভাগেও পদোন্নতি নিয়ে বৈষম্য রয়েছে বলেও জানা গেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পার অধিশাখা) হোসেন আলী খোন্দকার আমার সংবাদকে বলেন, ‘আসলে বৈষম্যের কথা মানুষ বলে, তবে কেন বলে এটা আমাদের জানা নেই। এখানে পদোন্নতির নির্ধারিত শর্ত আছে। শর্তগুলো যারা পূরণ করবে আর শূন্য পদ যে কয়টা রয়েছে সে শূন্য পদ দেখেই প্রমোশন হবে। এটাই নিয়ম। আমরা সেভাবেই করছি। পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য আনতে হয়। ডিজি অফিস থেকে তথ্য দিয়েছে। আমরা সেটি আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি।
অর্থাৎ পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি রয়েছে, সে পদ্ধতিই আমরা অনুসরণ করছি।’ পদোন্নতির জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে কেউ কেউ এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমি কিছু বলব না। এটা আমার সেকশনের না। তাছাড়া এটা অতীতের ঘটনা। যারা অনিয়ম করেছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে এটা প্রমাণিত হওয়ার পরে শাস্তিও দেয়া হয়েছে। এটি শৃঙ্খলা শাখা থেকে করেছে।
সম্প্রতি সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যে প্রক্রিয়া চলছে এটিতে কতজনকে পদোন্নতি দেয়া হবে এবং এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ পদোন্নতি প্রায় পাঁচ বছর পর হচ্ছে এ তথ্য সঠিক কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আগে কবে পদোন্নতি হয়েছে তা আমার জানা নেই। আমি এখানে আসছি প্রায় বছরখানেক হয়েছে।’
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর পদোন্নতির জন্য ঠিক কতজন চিকিৎসক আবেদন করেছেন এবং কতজনকে পদোন্নতি দেয়া হবে এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. শামিউল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটা এখনো শেষ হয়নি। এ বিষয়ে তথ্য দেয়া আছে। যাচাই-বাছাই শেষে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পরে বলতে পারব।’
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিকিৎসক বলেন, যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এখন খুব কমই পদোন্নতি হয়। এক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে যারা প্রভাব খাটাতে পারে তারা অনেক সময় জুনিয়র হয়েও পদোন্নতি পেয়ে যায়।
চিকিৎসকদের অনেকেই বলছেন, পদোন্নতির বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে হয়। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রথমে একটি তালিকা করা হয় এবং সাধারণত শূন্যপদ পূরণ করে পদোন্নতি হয়। তবে মাঝে মধ্যে শূন্যপদের বাইরেও প্রমোশন দেয়া হয়। পদ কম থাকার কারণে অনেকেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পান না। এক্ষেত্রে সিনিয়রিটির বিষয়টিকে প্রায়রিটি দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা অনেক। তাই চাহিদার তুলনায় পদোন্নতি কম হয়।’
১৯৯৯ সালে বিসিএসে উর্ত্তীণ স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেয়া (বর্তমান পদোন্নতির জন্য আবেদন করায় হাসপাতাল ও নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক চিকিৎসক জানান, ২০১১ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। এরপর এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর হতে চলেছে এখন পর্যন্ত সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আর কোনো পদোন্নতি পাননি তিনি।
তিনি বলেন, যথাসময়ে পদোন্নতি না হওয়ায় যতটা না আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, তার চেয়ে বেশি মর্যাদা সংকটে ভুগছি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী অধ্যাপকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। সংশ্লিষ্ট কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে। দ্রুতই পদ খালি থাকা সাপেক্ষে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা বৈষম্যের সুযোগ নেই। আর যে সব অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয় বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে স্বাস্থ্য ক্যাডারে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়া উচিত নয় বলে বলছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।
বৈষম্যের কারণ সম্পর্কে আমার সংবাদকে তিনি বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কিছু কারণে সমস্যা হয়, আবার বড় কেউ এসে বলে যে আমার এটা করে দেন, এটাও একটা কারণ। এটা আমাদের কারোর জন্যই কাম্য নয়।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি ডা. চিন্ময় কান্তি দাস বলেন, পদোন্নতি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। অন্য দেশে এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে। এর প্রধান কারণ প্রশাসনিক জটিলতা। প্রশাসনিক জটিলতার কারণে পদোন্নতি স্থবির হয়ে আছে। পদোন্নতির ব্যাপারে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার দাবি জানানো হচ্ছে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) সাধারণ সম্পাদক ডা. খলিলুর রহমান জানান, পদোন্নতি হচ্ছে। তবে যে গতিতে হওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছে না। সার্বিক বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের বক্তব্য চেয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।