কয়েকশ বছরের পুরোনো যানবাহন ঠিকা গাড়ি, বর্তমানে যা টমটম গাড়ি নামে পরিচিত। ঢাকার রাজপথে প্রায়ই দেখা যায় ঘোড়া দিয়ে চালিত এ পেশিশক্তির পরিবহন। পিচঢালা পথে ১২ থেকে ১৪ জন যাত্রীসহ গাড়ি বয়ে চলে। কিন্তু এ জন্য যে পরিমাণ বিশ্রাম ও পরিচর্যার প্রয়োজন তার কিছুই পায় না ঘোড়াগুলো।
উপযুক্ত বাসস্থান, পুষ্টিকর খাবার আর চিকিৎসার অভাবে কিছু দিনের মধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে কখনো কাজে বেরিয়ে মৃত্যু হয়, কখনো বা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। পুরোনো ‘ঐতিহ্য’ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এভাবেই নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকছে অসহায় প্রাণীগুলো।
সরেজমিন দেখা গেছে, বঙ্গবাজারের পাশে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের খোলা জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘোড়া রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মেঝেটা ময়লা ও স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। আশপাশে ছড়াচ্ছে ময়লার দুর্গন্ধ। ভেতরে স্তূপ ময়লার ওপর দাঁড়িয়ে ও বসে আছে কয়েকটি ঘোড়া। এর মধ্যে দুটির শরীরের বিভিন্ন স্থানে বীভৎস ক্ষত। ক্ষতগুলো ঘিরে মাছি ভনভন করছে। ড্রামে খাবরের জন্য কিছু পরিমাণ ধানের তুষ ও গম দেয়া আছে। কিন্তু খাবারের দিকে খুব একটা আগ্রহ নেই। দুর্বল আর ক্লান্ত শরীরের ঝিমুচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঘোড়াকে সকাল-সন্ধ্যায় দুই বেলা খেতে দেয়া হয়। সাধারণত খাবারের তালিকায় থাকে ছোলা, ধানের কুড়া, ঘাস ও গম। প্রদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকার ভূষি লাগে। দুটি ঘোড়ার জন্য একবস্তা ঘাস লাগে যার দাম ১০০ টাকা। ঘোড়ার গাড়ির মালিকরা বলেন, এসব পণ্যের দাম বাড়ায় খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে এখন আর ঘোড়াকে তিন বেলা খাবার দেয়া সম্ভব হয় না। এতে দিন দিন পুষ্টিকর খাবার অভাবে দুর্বল হয়ে মারা যাচ্ছে ঘোড়াগুলো।
ঘোড়ার গাড়ির মালিক জামাল হোসেন বলেন, গাড়ি টানা বেশির ভাগ ঘোড়াই পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে মারা যায়। অনেক সময় কিনে আনার দুই বছরের মাথায়ই মারা যায় ঘোড়াগুলো। এদের মধ্যে কাজে বেরিয়ে স্ট্রোক করে মারা যায় বেশি। ঘোড়া অসুস্থ হলেও চিকিৎসার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারি পশু হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসক দেখানো গেলেও ওষুধ কিনতে হয় নিজেদের। ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় কেউ বাড়তি খরচ করতে চান না। অসুস্থ হলে ঘড়াগুলোকে কম দামে বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করেন তারা। ঘোড়া মারা গেলে মালিককে লসে পড়তে হয়।
বিউটি টমটম সার্ভিসের মালিকে সাথে কথা বলে জানা যায়, ঘোড়ার গাড়ি থেকে লাভও দিন দিন কমছে। ডিসেম্বও থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা একটু বেশি থাকে। তখন বিয়েশাদীর জন্য মানুষ ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে। অনেক সময় বিভিন্ন জাতীয় দিবস বা রাজনৈতিক দলের শোভাযাত্রায়ও টমটম নেয়া হয়।
এছাড়া বাকি সময় গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের সামনে থেকে সদরঘাট মোড় পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার রাস্তায় চলাচল করে এগুলো। প্রতি ট্রিপে ১২ জন যাত্রী নিতে পারে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা। এতে ঘোড়ার খাবার ও চালকের খরচ দিয়ে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা থাকে। বর্তমানে সদরঘাট-গুলিস্তান রুটে ১৫ থেকে ২০টি ঘোড়ার গাড়ি চলে। ১০ বছর আগের তুলনায় সংখ্যাটা অনেক কম, ১০ বছর আগে এই রুটে চলত ৮০ থেকে ১০০টির মতো টমটম।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শায়ের মাহমুদ ইবনে আলম বলেন, ‘পিচঢালা রাস্তায় হাঁটা ঘোড়াগুলোর জন্য খুবই কষ্টকর। এর ওপর অতিরিক্ত ওজন টানায় তাদের স্বাস্থ্য আরও ঝুঁকির মুখে পড়ে। ঘোড়াকে দিয়ে এত বেশি পরিমাণ ওজন টানানো অমানবিক।
এছাড়া ঘোড়াগুলোকে পুষ্টিকর খাবারও দেয়া হয় না। ঘোড়ার পুরো দেহের তুলনায় পেটের আকার ছোট হওয়ায় কিছুক্ষণ পরপর অল্প পরিমাণে খায়। সারা দিন ঘাস, খড় খেতে হয় কিছুক্ষণ পরপরই। একবারে খুব বেশি খেতে পারে না প্রাণীটি। তাই এদের পুষ্টিকর খাবার দিতে হয়। ধানের তুষ, গমের মতো খাবার খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া ক্ষতিকর এদের জন্য। কিন্তু টমটম গাড়ির জন্য ব্যবহূত ঘোড়াগুলোকে এসব খাবারই বেশি খাওয়ানো হয়। ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রম আর পুষ্টিকর খাবারের অভাবে অল্পদিনেই অসুস্থ হয়ে ঘোড়াগুলো মারা যায়।