ঈদ-পূজাসহ বড় উৎসবগুলো ঘিরে সক্রিয় হয় জালনোট চক্র। এবারের ঈদুল আজহা ঘিরেও চক্রগুলোর সক্রিয়তা নজরে এসেছে প্রশাসনের। এ বিষয়ে তৎপর আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ছক আঁকা হয়েছে।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। ইতোমধ্যে পশুহাটের পাশে জালনোট পরীক্ষা বুথ স্থাপনে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে আহ্বান জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে মূলত কোরবানির পশুর হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উপজেলা সদর পর্যায়ে সরকার অনুমোদিত কোরবানির পশুর হাটগুলোতে জাল নোট চক্রের অপতৎপরতা রোধে বুথ স্থাপন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাট শুরুর দিন থেকে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ব্যবসায়ীদের বিনাখরচে নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা দিতে বলা হয়েছে।
গত ২৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পাঠিয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ নির্দেশনা পালন করতে বলা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, জাল নোট চক্রের সদস্যরাও নিত্যনতুন কৌশলে কাজ করছে। বর্তমানে ধাপে ধাপে চক্রের সদস্যদের মোতায়েন করে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। মাঠ পর্যায়ে প্রথমে দুটি জাল নোট ছড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষা করছে। সফল হলে এরপর ৫০টি জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে তা বাড়ছে।
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও মফস্বলের শহরগুলোতেও তারা ধীরে ধীরে টার্গেট বাড়াচ্ছে। পুলিশ ও র্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, উৎপাদকের এক লাখ জাল টাকা তৈরি করতে খরচ হয় সাত থেকে ১০ হাজার টাকা।
পরে তারা পাইকারি ক্রেতা বা ডিলারের কাছে এক লাখ জাল টাকা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। পাইকারি বিক্রেতা প্রথম খুচরা ক্রেতার কাছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, প্রথম খুচরা বিক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতার কাছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে।
সবশেষে দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতা মাঠপর্যায়ে সেই টাকা আসল এক লাখ টাকায় বিক্রি করে থাকে। অর্থাৎ অন্তত পাঁচটি হাত বদল হয়ে জাল টাকা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে। প্রতিটি চক্রের রয়েছে ২০ থেকে ২৫ সদস্য। তারা বিভাগ, উপজেলা-জেলা পর্যায়ে কাজ করে।
গোয়েন্দ সূত্রের তথ্যমতে, কেবল ৫০০ কিংবা হাজার টাকা নয়, এবারে ছোট নোট জাল করার দিকেই বেশি ঝুঁকেছে চক্রের সদস্যরা। বড় নোটের ক্ষেত্রে অধিক সতর্ক দৃষ্টি থাকায় তুলনামূলক কম নজর দেয়া ১০০ টাকা এবং ৫০ টাকার নোট জাল করার কাজ বেশি হচ্ছে।
মূলত এবারের কোরবানির ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটায় ছোট পরিমাণের জাল নোট সরবরাহের লক্ষ্যে চক্রের সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে। জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিবারের মতোই এবারও কোরবানির পশুর হাট, বিপণিবিতান ও শপিংমলকে প্রধান টার্গেট হিসেবে বেছে নিচ্ছে টাকা জালকারী চক্র।
গত ২৭ মে রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসায়ী চক্রের দুই সক্রিয় সদস্য রমজান হোসেন টুটুল ও আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র্যাব। বংশালের আবাসিক হোটেল টিউলিপের ১৩৫ নম্বর রুম ভাড়া নিয়ে সেখানেই জাল নোট তৈরির কাজ করছিল তারা।
এসময় তাদের কাছ থেকে জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ দুই লাখ ৯ হাজার টাকা মূল্যমানের জাল নোট, একটি সিপিইউ, একটি মনিটর, একটি প্রিন্টার ও তিনটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
এছাড়া গত ২ জুলাই নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর সময় নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। তার কাছ থেকে ১৫ হাজার পাঁচশ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। এ সময় পালিয়ে গেছে বাবুল মিয়া নামের মূল হোতা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মো. মশিউর রহমান বলেন, ঢাকা শহরের সব প্রত্যন্ত এলাকায় জাল নোট চক্র বেশি তৎপর। বিশেষ করে সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে এদের তৎপরতার খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি জানান, চক্রগুলো আগে বড় নোট জাল করত, এখন ছোট নোটে অর্থাৎ ১০০ টাকায় চলে গেছে। গরুর হাটসহ যেখানেই তারা সুযোগ পাবে সেখানেই জাল নোট ছড়িয়ে দিতে তৎপরতা চালাবে। সার্বক্ষণিক এ চক্রগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
পাশাপাশি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকেই এ বিষয়ে বাড়তি সচেতন হতে হবে। ইতোমধ্যে জাল নোট চক্রের তৎপরতার পাশাপাশাশি কোরবানির পশুর হাটের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ও করোনা প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
রাজধানীর ১৭টি পশুর হাটেই থাকবে সিসি ক্যামেরা, জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ, সাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের নজরদারি, কন্ট্রোল রুম, উঁচু টাওয়ার থেকে হাটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাসহ পোশাকি পুলিশ ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে।