আন্তর্জাতিক বাজারে টানা কমছে দেশে স্থিতিশীল

সিন্ডিকেটের কব্জায় ভোজ্যতেল

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২২, ১২:৪২ এএম
সিন্ডিকেটের কব্জায় ভোজ্যতেল

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি সবাই। সরকার চেষ্টা করেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। উল্টো ব্যবসায়ীদের আবদার মেটানোই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কাজ হয়ে গেছে। আবদার না রেখে উপায় নেই। কারণ সরকারের সাথে প্রকাশ্য লড়াইয়ে নেমে যান তেল ব্যবসায়ীরা। 

রমজানের আগে লিটারে ১২ টাকা দাম বৃদ্ধির দাবি প্রত্যাখ্যান করে সাহস দেখিয়েছিলেন মন্ত্রী। তাই বাজার থেকে তেলই গায়েব করে দেন ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে দাম বাড়াতে রাজি হয় সরকার। লিটারে বাড়ে ৩৮ টাকা! আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে দেশের বাজার দাম বাড়ানো হয়। 

আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে বলা হয়— আগের দামে কেনা, বেশি দামে বুকিং ইত্যাদি। মূলত চলতি বছরে এসে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা। গত বছরের তুলনায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কম থাকলেও দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে। 

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে দাম ছিল ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ছিল এক হাজার ৩৮৫ ডলার। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে একপর্যায়ে তা বেড়ে যায়। মার্চে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম হয় এক হাজার ৯৫৬ ডলার। তখন দেশের বাজারেও দাম বাড়ে। 

দেশে খোলা সয়াবিন তেলের রেকর্ড দাম নির্ধারণ করা হয় ১৮৫ টাকা। আর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ওঠে ২০৬ টাকায়। সর্বশেষ ১৩ জুলাই পাম অয়েলের টনপ্রতি দাম কমতে কমতে ৯৪১ ডলার এবং সয়াবিনের দাম নেমে আসে এক হাজার ৩৫৩ ডলারে। অর্থাৎ টনপ্রতি বর্তমান দাম গত বছরের তুলনায় ৩২ ডলার কম। 

টিসিবির মূল্য তালিকা অনুযায়ী গত বছরের ১৬ জুলাই এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১১৫-১২০ টাকা, বর্তমান দাম ১৭০-১৭৬ টাকা। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৪০-১৫০ টাকা, বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলের দাম ১৯৫-২০৫ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতল ৯৬০-৯৯০ টাকা, যা আগে ছিল ৬৭০-৭১০ টাকা। 

ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আন্তর্জাতিক দামের দোহাই দিলেও এটিকে ব্যবসায়ীদের কূটকৌশল তা এখন সর্বমহলে পরিষ্কার। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সবাই। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবসায়ী শ্রেণির অধিক বিচরণ ও রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ে সরকারের শিথিলতার প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছে ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব। 

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার প্রেক্ষাপটে দেশে দ্রুত দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
বিবৃতিতে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন দাম বাড়াতে যতটুকু আগ্রহী, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে কমাতে তেমন আগ্রহী না হওয়ার কারণে ভোজ্যতেলের বাজারে এখনকার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। 

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশীয় বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দীর্ঘদিনেও দেশীয় বাজারে পণ্যটির দাম সমন্বয় করা হয় না। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশীয় বাজারে দাম বাড়ে, কিন্তু দাম কমলে ব্যবসায়ীরা উল্টো সুর ধরেন। বেশি দামে কেনা বা বুকিং রেট বেশিসহ নানা অজুহাত দেখান। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত দাম কমার পরও দেশে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী একাধিকবার আশ্বাস দিলেও সে আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। 

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিল, তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা তেল দেশের বাজারে আনলে দাম কমার কথা ছিল। 

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বিপরীত ঘটেছে এবং ভোক্তারা তার কোনো সুফল পাননি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, দেশে তার বিপরীতে বাড়ানো হচ্ছে। আবার ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের উল্টো সুর হলো— ভোজ্যতেলের এফওবি দাম কমলেও বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলারের উচ্চমূল্যসহ নানা ভৌতিক কারণে দাম আগের অবস্থানে ফিরছে না। এটি ব্যবসায় সুশাসন, ব্যবসায়িক নীতি নৈতিকতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।

ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম পাঁচবার উঠানামা করেছে। এর মধ্যে তিন দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারসাজিতে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে বেসামাল হয় ভোজ্যতেলের বাজার। ফলে অক্টোবরে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৩৬ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন ১৬০ টাকা বেঁধে দেয়া হয়। 

কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটার ২১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি লিটারে আট টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সে সময় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ নির্ধারণ করা হয়। 

পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর রমজানের ঈদের পর গত ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার পুনঃনির্ধারণ করে। ওই সময়ে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি রেকর্ড পরিমাণ বাড়িয়ে ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর গত ৯ জুন কোনো কারণ ছাড়াই মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। 

এর মধ্যে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৯৯ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের খোলা পাম অয়েলের (সুপার) দাম মিলগেটে ১৫৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৫৫ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৮ টাকা করা হয়। 

এক্ষেত্রে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি পাঁচ থেকে সাত টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তিন মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ২০০ থেকে ৪৯০ ডলার কমলেও দেশে তার বিপরীতে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে বৈঠক করে এক মাসে দু’দফায় প্রতি লিটার সয়াবিনে দাম বাড়িয়েছেন ৫১ টাকা।