বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করছেন অনেকেই। আবার অবৈধভাবে রাখছেন গানম্যানও। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ অস্ত্রের লাইসেন্স পেলেও শো-অফের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই গানম্যান নিয়েও ঘুরছেন। এতে স্থানীয়ভাবে পোক্ত হচ্ছে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ।
সাধারণ মানুষের মধ্যেও সৃষ্টি হচ্ছে ভীতিকর পরিস্থিতি। কেউ কেউ আবার গানম্যান ছাড়া নিজেই লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ছেন প্রতিপক্ষের ওপর, করছেন শো-অফ, উল্লাসনৃত্য। এসব দৃশ্যও আবার ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও। সম্প্রতি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের কথিত যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান জুয়েলও ঘটিয়েছেন একই কাণ্ড।
জানা গেছে, একই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদারের ওপর সংঘবদ্ধ হামলা চালায় জুয়েল। চেয়ারম্যানের দাবি অনুযায়ী, হামলার সময়ও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সেই অস্ত্রটি তার হাতে ছিল এবং সেই অস্ত্র নিয়েই হামলার পর করা উল্লাসের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
ছবিতে দেখা যায়, অভিযুক্ত মনিরুজ্জামান জুয়েল মিয়াবাজার গ্রিনভিউ রেস্টুরেন্টের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে উল্লাস করছেন। যদিও স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, ভাইরাল হওয়া এই ছবি ওই হামলার ঘটনার আগের। তাছাড়া চেয়ারম্যান শাহজালাল ও জুয়েল সম্পর্কে চাচাতো-জেঠাতো ভাই। তাদের পারিবারিক বিরোধের জেরে সৃষ্ট ঘটনাকেই এখন রাজনৈতিক রূপ দেয়া চেষ্টা করছেন চেয়ারম্যান শাহজালাল। এরই মধ্যে অস্ত্রের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল ও গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশের পরই কার্যত টনক নড়ে প্রশাসনের।
দেশজুড়ে ভাইরাল হওয়া অস্ত্রের সেই ছবি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠার পরই মূলত জুয়েলকে আটক ও অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। প্রশাসনের চলমান তৎপরতার মধ্যেই গতকাল শনিবার স্বামীর অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে জুয়েলের স্ত্রী ফারজানা হক ২.২ বোর রাইফেল নং অ৩৫৪৯১৬ সহ ৮৬ রাউন্ড গুলি থানায় জমা দেন।
এর আগে গত মে মাসেও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ কায়েতপাড়া এলাকায় রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগ নেতা মোশারফ হোসেন মশা। মশাবাহিনীর সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে তিনজন গুলিবিদ্ধও হন।
স্থানীয় সূত্র বলছে, মোশারফ হোসেন মশার সাথেও লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। সেই অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তার সাথে সবসময় গানম্যানও থাকে। রফিকুল ইসলামের ওপর হামলার দিনও সেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় সূত্র। আর গানম্যানদের উৎপাতে সবসময়ই শঙ্কিত থাকেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা বলছেন, একেক সময় একেক জনকে গানম্যান হিসেবে সাথে রাখায় তাদের অনুমোদনের বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে স্থানীয়দের। রফিকুল ইসলামের ওপর হামলার পরের মাসেই গ্রেপ্তারও করা হয় মশাকে। নেয়া হয় একদিনের রিমান্ডে। একই (মে) মাসে আবার আবু বক্কর সিদ্দিকী রাতুল নামে পাবনার সুজানগর উপজেলা ছাত্রলীগের এক নেতাও অস্ত্র হাতে ছবি তুলে সামাজিকমাধ্যমে দেন। মুহূর্তেই সেই ছবিও ভাইরাল হয়।
রূপগঞ্জের মোশরাফ হোসেন মশার পর র্যাবের হাতে ছাত্রলীগ নেতা রাতুলও গ্রেপ্তার হন, যদিও এখন পর্যন্ত রহস্যজনক কারণে গ্রেপ্তার করা যায়নি কুমিল্লার জুয়েলকে। রাতুলের সেই অস্ত্রও উদ্ধার করেছে র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদে রাতুল র্যাবকে জানিয়েছিল, ‘আমার কাছে যে একটা অস্ত্র আছে, সেটা এলাকার সবাইকে দেখানোর জন্যই ফেসবুকে ছবি দিয়েছি, যাতে এলাকার লোকজন আমাকে ভয় পায় এবং আমার কথা শুনে চলে।’
এ ছাড়াও সামপ্রতিক সময়ে রাজধানীর নিউমার্কেটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেসব জায়গায় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, প্রায় সব জায়গাতেই অস্ত্রের দেখা মিলেছে। যে কারণে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের প্রবণতা যেন ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছে। যদিও বেশ কিছু দিন ধরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কোনো অভিযানের খবর পাওয়া যায়নি।
তবে পুলিশ বলছে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার সবসময়ই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে এখন দেশের প্রতিটি জায়গায় প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে অস্ত্রবিরোধী বিশেষ অভিযান চালানো হয়। আর যেসব ঘটনায় অস্ত্র প্রদর্শিত হচ্ছে তারা গ্রেপ্তারও হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, গত চার মাসে রাজধানীতে গুলিতে একজন আওয়ামী লীগ নেতা খুন হওয়া ছাড়া আর কোথাও অস্ত্রের ব্যবহার হয়নি। রাজধানীর নিউমার্কেটে ব্যবসায়ীদের সাথে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাথে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় যে অস্ত্রের ছবি সামাজিকমাধ্যম ও গণমাধ্যমে এসেছে সেগুলো উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অস্ত্রধারী সেই নেতাদের অনেককেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
অস্ত্রের এমন প্রদর্শনের কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অস্ত্রের এই প্রদর্শন আমাদের তিনটি বার্তা দেয়। প্রথমত, এই অবৈধ অস্ত্র যারা সংগ্রহ করেন বা রাখেন, তাদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো না কোনো সদস্যের সখ্য রয়েছে। সেই সখ্যের ভিত্তিতেই তারা এই সাহসটা পায়। গণমাধ্যমে অস্ত্রসহ ছবি ছাপা হওয়ার পরও তাদের মধ্যে কোনো ধরনের অপরাধবোধ বা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়ার লক্ষণ আমরা দেখতে পাই না।
দ্বিতীয়ত, অস্ত্র প্রদর্শন করে কেউ যখন নিজের বীরত্ব প্রকাশ করতে চায়, তখন বুঝতে হবে সমাজে এদের প্রভাব বেড়ে গেছে। তারাই সমাজের চালিকাশক্তি। সেখানে সাধারণ মানুষের গুরুত্ব কম। আর তৃতীয়ত, আগে আমরা দেখতাম এই ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠতে। এখন সেটি দেখা যায় না। কেউ প্রতিবাদ করে না। কারণ, এদের সবাই ভয় পায়। ফলে সাধারণ মানুষ একটা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে দিন পার করছে।’
গত জানুয়ারি মাসে শেষ হওয়া ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় মারা গেছেন ৯৫ জন। সে সময় সারা দেশেই নির্বাচন ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয় এবং ওই সময়ের নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনাগুলোতেও অবৈধ অস্ত্রের প্রদর্শন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে-পরে অবৈধ অস্ত্রবিরোধী বিশেষ কোনো অভিযান দেখা যায়নি।
এদিকে দেশে প্রবেশের সময় সীমান্ত থেকে গত ১০ বছরে এসএমজি, রাইফেল, রিভলবার, পিস্তল, বন্দুকসহ অন্তত দেড় হাজার অস্ত্র উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। র্যাবের অভিযানে ২০২১ সালে দেশি-বিদেশি ৮৪৪টি অস্ত্র, ১৭৯টি ম্যাগজিন, ছয় হাজার ৮৫৯ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১২ হাজার ২৮টি বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। যেসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তার বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যা, চাঁদাবাজিসহ প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করে। আরেকটি ব্যবহার হয়ে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাজনৈতিক সংঘাতের সময় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র আসতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এমনিতেই বছরে এক হাজারেরও বেশি অবৈধ অস্ত্র আসছে দেশে। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তেই দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পর্যায়ে পৌঁছেনি।