আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় বড় লোকসান ছাড়াও ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানিতে বিঘ্ন ঘটছে। ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সর্বোচ্চ।
এছাড়া ডিজেল রিজার্ভ করতে তীব্র জ্বালানি সংকটেও দেশে ছয়টি বেসরকারি ও একটি সরকারি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। এই সাতটি কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২২৫ মেগাওয়াট।
আর এর ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে, বাড়বে লোডশেডিং। জ্বালানির দামে অস্থিতিশীতার কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) প্রতিদিন লোকসান গুনতে হচ্ছে মত কোটির চয়েও বড় অঙ্কের টাকা। ফলে শিগগিরই বাড়বে জ্বালানির দাম।
এদিকে সংকট ঠেকাতে এলাকাভিত্তিক সিডুয়েল লোডশেডিং চলছে কিন্তু যে দাম ধরে তারা এই লোকসান হিসাব কষছে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাদের তো মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার রাখেনি।
এদিকে সরকার এখন জিজেল রিজার্ভে মনোযোগী হচ্ছে। জ্বালানি সংকটকে সরকার কেবল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করছে।
অথচ এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এম শামসুল আলম বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির কারণেই এ সংকট হয়েছে।
কিন্তু আমরা মনে করি, সরকারের ভুল নীতির কারণেই এটি হয়েছে। সরকার ইচ্ছা করেই নিজস্ব নতুন কোনো গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের চেষ্টা করেনি। এক সময় বলা হতো দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বহু আগ থেকেই বলতে শুরু করলেন, মাটির নিচে গ্যাস নেই। দুটোই অসত্য।
এখনো আমাদের বিদ্যুতের ৬০ শতাংশের বেশি আসে দেশীয় উৎস থেকে। সরকার যদি বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে না। ভোক্তার স্বার্থের কথা তারা ভাবছে না। তিনি মনে করেন কিছু মানুষের পকেট ভারী করতে গিয়ে জ্বালানি সংকট তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস-তেল সরবরাহ কমিয়ে লোডশেডিং শুরু করা হয়। এতেও জ্বালানি সংকট নিরসনে খুব একটা আশার বাণী শুনাতে পারছে না বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকার আর কোনো উপায় দেখছে না। নিত্য সব পণ্যে দাম যেভাবে লাফিয়ে বাড়ছে এর মধ্যে জ্বালানির দাম আবারও বাড়লে সাধারণ জনতার নাভিঃশ্বাস উঠবে।
সরকারের এই উদ্যোগের শুরুর দিনেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এক মাসের চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এরই অংশ হিসেবে গতকাল অফিসে এসেই অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বিপিসির হিসাবে, চলতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫৯ লিটার ধারণ ক্ষমতার ডিজেলের ব্যারেলের গড় মূল্য ছিল ১৭১ ডলার। এ ছাড়াও, এক ব্যারেল অকটেন ও অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল যথাক্রমে ১৪৮ ও ১১৫ ডলার।
বিপিসি সূত্র জানায়, প্রতি লিটার অকটেন ৮৯ টাকা ও ডিজেল ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় লোকসান হচ্ছে যথাক্রমে ৩৬ টাকা ও ৫৫ টাকা ১৫ পয়সা। বিপিসি এখন অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে এক লিটার পেট্রোল পেতে ৯৬ টাকা ৮৭ পয়সা খরচ করলেও তা ৮৬ টাকায় বিক্রি করে।
বিপিসি বছরে ৬২ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে, যারমধ্যে ৭২ শতাংশ ডিজেল, ৪ দশমিক ৮ শতাংশ অকটেন ও ৬ শতাংশ অপরিশোধিত তেল। বিপিসি প্রতিদিন শতকোটি টাকা লোকসান গুনছে।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেন, দাম পরিবর্তন করব কি-না, কোথায় সমন্বয় করব বা আদৌ করব কি-না এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি। এরপর সরকারের কাছে প্রস্তাব করব।
তিনি বলেন, লোকসানের দায় কে নেবে? আমাদের গ্রাহকরা আছেন, যারা জ্বালানি পরিবহন করেন তাদের ওপর কোনো চাপ পড়ুক তাও আমরা চাই না। আমরা চাই সমন্বয় করতে। সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট করে। বাড়লে বাড়ায়, কমলে কমায়। আমরা এই মুহূর্তে সেদিকে যাবো কি-না, সেটা চিন্তার বিষয়।
এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে ভারতের সাথে এখন আমাদের তেলের দামের অর্ধেক পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে। সে তুলনায় এখনো আমরা স্থিতিশীল অবস্থায় আছি। আমরা কতটা বাড়াব, সে জায়গাটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিপিসি বা জ্বালানি বিভাগের তেলের দাম নির্ধারণের কোনো এখতিয়ার নেই। কারণ বিপিসি নিজেই এখানে ব্যবসা করে। ডিজেল ও কেরোসিনসহ জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে প্রশাসনিক প্রতিকার না পেলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
এদিকে বিপিসি বলছে উচ্চ মূল্যের তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করায় এ খাতেও লোকসানের বোঝা ভারী হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়ে গেছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝাও। সরকার ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যুৎ খাতে।
এতে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে মহাবিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিচ্ছে সরকার। বিপিসি, বিইআরসি, পেট্রোবাংলাসহ এসব কোম্পানির পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকায় জ্বালানি খাতে নৈরাজ্য নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে কয়লায় ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, গ্যাসে ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েলে ২৮ শতাংশ ও ডিজেলে ৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। তবে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। তবে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ২২ টাকা। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক। এর প্রভাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয়ও বাড়ছে।
অন্যদিকে বর্তমানে গড়ে প্রতি ইউনিট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ১৫ পয়সা। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ১০ টাকা। বড়পুকুরিয়ার কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় চার টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় ছয় টাকা, সোলারে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ১২ টাকা। ফার্নেস অয়েলে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ১২ টাকা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে জ্বালানি তেলে দাম বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎ খাতে ক্রমাগত ভর্তুকি বেড়েই চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।
তবে ২০২১-২২ অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসেই ভর্তুকি দেয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এরপর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রাখে সরকার। এতে সংকটে পড়ে পিডিবি। নগদ তহবিল সংকটে গত মার্চ থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিপিসি।
এতে দেড় বিলিয়ন ডলার বিল বকেয়া পড়ে গেছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোয়। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল দ্রুত পরিশোধের দাবি জানিয়ে সমপ্রতি পিডিবিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা)।
সংগঠনটি জানায়, ৬০ শতাংশ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফেব্রুয়ারির বিল পেয়েছে। আর মার্চ থেকে কোনো কেন্দ্রই বিল পায়নি। তবে সে সময় ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা। এখন তা বেড়ে প্রায় ৯৪ টাকা হয়ে গেছে। এ নিয়ে জটিলতা বাড়ছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।