ডিজেল ও গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমেছে বিদ্যুতের। কৃচ্ছ্রতা সাধনে চলছে এলাকাভিত্তিক সিডিউল লোডশেডিং। দেশের সাতটি ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। রাত ৮টার পর বন্ধ জারি করা হয় দোকানপাট শপিংমলে। সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবশ্য বন্দর এলাকার পাম্পগুলো সপ্তাহে দুই দিন বন্ধের কথাও বলা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব বৈঠক ভার্চুয়ালি করার চিন্তা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অফিসের কর্মঘণ্টা কমানোর সুপারিশ, উপাসনালয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের আহ্বানসহ সংকট ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার। সরকার আশা করছে সেপ্টেম্বরের শেষে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এই সংকটের জন্য বিশ্ববাজারে তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির চড়া দামকে দায়ী করছে সরকার।
তবে বিশ্লেষকরা জানায়, বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সংকট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এই সংকট আরও বাড়বে। সংকটের মুখে সরকার এখন ডিজেলের ব্যবহার কমানোর ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু অকটেন-পেট্রোলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলের তুলনায় ডিজেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয়, যা অন্যান্য তেলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। সারা দেশে এলাকাভিত্তিক এক থেকে দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তবে তিনি এই লোডশেডিংকে সাময়িক বলে গণমাধ্যমকে জানান। তিনি বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে সাময়িক এই লোডশেডিং।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, দেশে কোনো জ্বালানি সংকট নেই। ডলার খরচ কমাতেই সরকার জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় এলএনজি কেনাও কমানো হয়েছে। অন্যদিকে বিপরীত কথা বলছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ। তিনি বলেন, দেশে ৪০ দিনের কম জ্বালানি রিজার্ভ আছে।
এদিকে এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের ঘোষণা থাকলেও মানা হচ্ছে না নিয়ম। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তিন-চারবার লোডশেডিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। সিডিইল ছাড়াও কখনো আধা ঘণ্টা কখনো এক ঘণ্টার লোডশেডিং থাকে। আর ঢাকার বাইরে আট থেকে ১০ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের কথা জানা যায়।
রংপুর প্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, রংপুরে এলাকাভেদে লোডশেডিংয়ের যে সময়সূচি করা হয়েছে, তা মানা হচ্ছে না। এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর বিদ্যুৎ এলেও আবার আধঘণ্টা পর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এমন অভিযোগ জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কার্যালয় সূত্র জানায়, রংপুর জেলায় প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা ১৫০ থেকে ১৫৫ মেগাওয়াট। সেখানে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৭৫ মেগাওয়াট। চাহিদার প্রায় অর্ধেক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কম। বগুড়া জেলার দুপুচাঁচিয়া উপজেলায় প্রায় ১০ ঘণ্টার লোডশেডিং থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে।
ভোক্তভোগীরা জানান, এক ঘণ্টার ঘোষণা দিয়ে থানা পর্যায়ে সাত-আট ঘণ্টা লোডশেডিং। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটা কোনো নিয়মে চালাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। অসুস্থ, বয়স্ক, শিশুদের বিষয় কি ভাবার কেউ নেই। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার ফরিদা কামাল আমার সংবাদকে জানান, সারা দেশে এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের কথা থাকলেও এখানে বালাই নেই নিয়ম মানার। তপ্ত গরমে এমনিতেই জনজীবন হাঁসফাঁস তার ওপর যুক্ত হয়েছে তীব্র লোডশেডিং।
গ্রামের লোকজন বলছেন, সকাল থেকে বিদ্যুৎ শুধু আসা-যাওয়া করছে। কোনো নিয়মের বালাই নেই। মার্কেটে কখন বিদ্যুৎ থাকবে আর কখন থাকবে না, তা বিদ্যুৎ অফিসের কাছে জানতে চাই।
এক ব্যবসায়ী জানান, বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ব্যবসা হয়। কিন্তু এই সময়ে এখানে বিদ্যুৎ নেই। এলাকার গুরুত্ব বুঝে সেই এলাকা লোডশেডিং করা উচিত বলে তার মতো।
এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদনশীল ও গুদামজাত কারখানাগুলো চালাতে বিপাকে পড়ছেন মালিকপক্ষ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। রংপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর দিয়ে হিমাগার চালানো হচ্ছে। এতে করে হিমাগারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এ কারণে মজুতকৃত পণ্যের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আলু বীজের সমস্যা আরও বেশি দেখা দিতে পারে।
এদিকে গ্যাস সংকটে দেশের অন্যতম বৃহৎ সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কারখানার (সিইউএফএল) উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দৈনিক লোকসান হবে পৌনে দুই কোটি টাকা। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সার কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এর আগে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এক সপ্তাহ বন্ধ থাকে সিইউএফএল। পরে গত রোববার রাতে কারখানাটি আবার চালু করা হয়। এবার গ্যাস সংকটে সেখানে উৎপাদনই বন্ধ হয়ে গেল।
কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, গ্যাসের ঘাটতি থাকায় সিইউএফএল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে কাফকোতে নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। সিইউএফএল সূত্র জানায়, কারখানার ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টে পূর্ণ উৎপাদনের জন্য দৈনিক ৪৭-৪৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার। কিন্তু কারখানার পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমতে শুরু করায় উৎপাদন বন্ধ করা হলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত সিইউএফএল কারখানা পুরোপুরি সচল রাখতে প্রয়োজন ৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এ কারখানায় দৈনিক এক হাজার টন অ্যামোনিয়া এবং এক হাজার ২০০ টন ইউরিয়া উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশন) প্রকৌশলীসারওয়ার হোসেন জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার রাত ১০টায় সিইউএফএলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়। আগে সিইউএফএলে ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পেলে আবারও গ্যাস সরবরাহ দেয়া হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এভাবে লোডশেডিং চলতে থাকলে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে। বন্ধ হবে আরও অনেক কারখানা। এই সংকট পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রেখে রফতানি-বাণিজ্যের বিদ্যমান গতিশীলতা ধরে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। শিল্প-কারখানা লোডশেডিংয়ের আওতামুক্ত রাখার জন্য মত দেন তারা। জ্বালানি ও ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম আমার সংবাদকে জানান, শিল্পাঞ্চলে যদি গ্যাস না দেয়া হয় তাহলে এর প্রভাব হবে আরও বড়। শিল্পের উৎপাদন কমে গেলে পণ্যের দাম বাড়বে।
বিশষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, ‘যত অবকাঠামো তৈরি করা হবে ততোই দেশের জন্য মঙ্গল। কারণ জ্বালানির নিরাপত্তার জন্য যেমন নিজস্ব জ্বালানি দরকার আছে, তেমনি আমদানিরও দরকার আছে।’
অধ্যাপক তামিম আরও বলেন, উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমি বলবো পেট্রোবাংলা ফেল করেছে। এই বিপদে এসে এখন বলছে আগামী তিন বছরে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করতে পারব। তাহলে ছয়-সাত বছরে আগে এটা করা হয়নি কেন।
লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি শুরু হয়েছে আবাসিক গ্যাসের তীব্র সংকট। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকেই এ সংকট দেখা যায়। আবার কোনো এলাকায় সারা দিনই গ্যাস সমস্যা দেখা গেছে। দুপুরে এলেও জ্বলছে টিমটিম করে। রান্না করার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হয়- বলছিলেন যাত্রাবাড়ীর মিরহাজিরবাগের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ গেল এবার দেখি আবাসিক গ্যাসেও তীব্র সংকট।
তিনি বলেন, ‘গতকাল সকালে বাসায় মেহমান আসছে । গ্যাস নাই সে জন্য বাইরে থেকে নাশতা নিয়ে আসছি। দুপুরেও গ্যাস নেই বাইরে থেকে ভাত তরকারি নিয়ে আসছি। রাতে হোটেল থেকে তরকারি নিয়ে আসলাম, ভাবছিলাম ভাতটা বাসায় রান্না করব। কিন্তু বাসায় এসে একই অবস্থা মিটিমিটি জ্বলে আগুন। মেহমান আবার সকাল ১০টায় বের হয়ে যাবে, নিচের হোটেলগুলো আবার কোরবানির পর থেকে বন্ধ। এখন সাত-আট মিনিটের দূরত্বে গিয়ে আবার ভাত নিয়ে আসলাম।’
একজন অভিযোগ করে বলেন, সকাল থেকেই গ্যাসের চাপ অনেক কম। রান্না করতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। পানি গরম হতেই অনেক সময় চলে যাচ্ছে। একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে রাজধানীর সেন্ট্রাল রোড, নর্থ রোড, নর্থ সার্কুলার রোড, ভুতের গলি, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, রামপুরার উলন, বনশ্রী ও মগবাজারের মধুবাগ এলাকা থেকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ জানান, আমাদের মোট চাহিদা প্রায় এক হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। বর্তমানে গড়ে পাচ্ছি এক হাজার ৬২৬ মিলিয়নের মতো। বিদ্যুৎকেন্দ্রে তো রেশনিং করাই হচ্ছে, সিএনজি আগেই রেশনিংয়ের আওতায় ছিল। এখন আবাসিকের কিছু এলাকায় গ্যাস কম পাচ্ছে।