শিল্প ও নগরায়ণের ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। শহরে উন্নত জীবনযাপনের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। শিক্ষার জন্য রয়েছে নামিদামি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চিকিৎসার জন্য শহরে রয়েছে অগণিত হাসপাতাল, ক্লিনিক যা মানুষকে সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে।
অন্যদিকে গ্রামের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নানা সুবিধা এখনো গ্রামপর্যায়ে পর্যাপ্ত নয়। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সরকার সারা দেশে এক ঘণ্টার লোডশেডিং ঘোষণা করেছে। শিডিউল লোডশেডিং থাকলেও মানা হচ্ছে না বিধি। ১০-১২ ঘণ্টার বিদ্যুৎহীনতায় গ্রামের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
চিত্র যেন দেখার কেউ নেই। লোডশেডিংয়ে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা একেবারেই নাজুক। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়াতে সম্প্রতি জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সারা দেশে এক ঘণ্টার লোডশেডিং ঘোষণা করেন।
এক ঘণ্টার নামে ৮-১০ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ছে গ্রাম, পল্লী বা মফস্বলের মানুষ। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে বা উন্নত চিকিৎসার জন্য গ্রামের মানুষকে শহরে আসতে হয়। নাগরিক জীবনে নানা সুবিধা কম থাকায় দিন দিন গ্রামের মানুষ শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
শহর-নগর-গ্রামের সবার নাগরিক সুবিধা সমান, সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। প্রজাতন্ত্রের সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করার সাংবিধানিক বিধি থাকলেও বৈষম্য থাকছে গ্রাম ও শহরে। শহরের মতো গ্রামে নাগরিক সুবিধা কম থাকায় অসন্তোষ দেখা যায় বিভিন্ন মহলে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের গ্রামে বদলিতে অনীহা দেখা দিয়েছে চরম আকারে।
আর গ্রামে অবস্থানরত চাকরিজীবীরাও নানা তদবির করে জেলা বা রাজধানীকেন্দ্রিক বদলির চেষ্টা করছে। নাগরিক সুবিধায় শহরে বদলিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর কর্মকর্তাদের শহরে নিয়োগের অন্যায়ে জড়িয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রাবণের বৃষ্টিতে তাপমাত্রা কমায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে বিদ্যুৎ খাতে। বিদ্যুতের চাহিদা কমায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা আগের চেয়ে কমেছে।
তবে চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ পাওয়ায় গ্রাম এলাকাগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। পিডিবি দিনে গড়ে সর্বোচ্চ চাহিদার পূর্বাভাস দেয় ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।
আর উৎপাদন ১২ হাজার ৫১ মেগাওয়াট। প্রায় দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ঘাটতি হতে পারে বলে জানায় আরইবি। এ ঘাটতি পূরণে গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করার দরকার বলে জানিয়েছেন পিডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে ৯৭৬ মেগাওয়াট সাশ্রয় হয়। বৃষ্টি নামায় চাহিদা পূর্বাভাসের চেয়ে কমেছে। তাই লোডশেডিং কমানো গেছে। সারা দেশে বিদ্যুৎ বিতরণ করে ছয়টি প্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ডিপিডিসি ও ডেসকো।
লোডশেডিংয়ের ঘোষণায় একটি এলাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করার কথা বলা হলেও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে দুই ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। বিভাগের শহরগুলোতে কিছুটা সহনীয় হলেও গ্রামগুলোতে রাতের বেশির ভাগ সময়ই থাকে অসহনীয় লোডশেডিং।
ময়মনসিংহের এক বাসিন্দা জানান, রাতে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা সময় আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি। ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রীয় অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে দিনের বেলায় প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে।
এ চাহিদার বিপরীতে দিনের বেলায় উৎপাদিত হয় ৬০০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াট। রাতে এ চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। রাতে উৎপাদিত হয় সর্বোচ্চ ৯৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
যে কারণে ঘোষণার চেয়ে বেশি লোডশেডিং করতেই হচ্ছে। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগে পল্লী বিদ্যুৎসহ রাতে বিদ্যুতের চাহিদা ৯৫০ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট। আর দিনের চাহিদা ৭৬০ থেকে ৭৮০ মেগাওয়াট।
সিলেটে পিডিবি-২ এর আওতাধীন এলাকায় এক দিন ১৩ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের একটি সূচি প্রকাশ করে। অবশ্য পরবর্তীতে এ সূচি পরিবর্তিত করে আগের মতো সূচি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির।
পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী বলেন, বিভাগীয় শহর হিসেবে আমরা লোড কম পাচ্ছি। এক দিনের বরাদ্দ পেয়েছি ৯৩ মেগাওয়াট, যেখানে চাহিদা ১৭৫ মেগাওয়াট। অন্য একদিন একই চাহিদার বিপরীতে পেয়েছিলাম ৭৮ মেগাওয়াট। এই লোড দিয়ে সরবরাহ সামলাতে পারছি না, এতে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে সারা দেশে বিদ্যুতের শিডিউল লোডশেডিং শুরু হলেও বরিশাল বিভাগের পাঁচটি জেলায় এর প্রভাব খুব কম। অপেক্ষাকৃত ভালো সরবরাহ রয়েছে।
বিভাগের কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক আছে। বিদ্যুৎ বিতরণের মাধ্যমে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং শহর ও গ্রামের ব্যবধান ঘোচানোর জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে পিডিবি।
বিদ্যুৎ সেক্টরে জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করা হবে বলে জানায় পিডিবি। সরকার জ্বালানি খাতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, সরকার বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানির জোগান দিতে না পারায় এ সমস্যা হয়েছে। ফলে তেলের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। আর তেলের ওপর এই নির্ভরতার কারণেই বর্তমান সমস্যা তৈরি হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হলেও নতুন করে তিন কোটি লোক দারিদ্র্যসীমায় যুক্ত হয়েছে। গ্রাম ও শহরে বৈষম্য বাড়ছে। মানুষের আয় কমেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে এক ধরনের অবিচারের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।