পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ২০১০ সালে বিমা করেছেন সুনামগঞ্জের বীর ইউনিয়নের হায়দার আলী। কোম্পানির এক স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে নিজের ও স্ত্রীর বিমা করেন। প্রায় তিন বছর চালানোর পর আর্থিক সমস্যার কারণে আর প্রিমিয়াম দিতে পারেননি।
অবশ্য বন্ধ করার আগ পর্যন্ত নিয়মিত প্রিমিয়াম দিলেও একটি রসিদও পাননি তিনি। ২০১৭ সালে হায়দার আলী মারা গেলে অথৈ পাথারে পড়ে তার পরিবার। বিমার টাকার জন্য স্থানীয় এজেন্টের কাছে ধরনা দিলেও লাভ হয় না।
এজেন্ট জানায়, নিয়মিত প্রিমিয়াম না দেয়ায় এবং সময়ের আগেই বন্ধ করে দেয়ায় ওই টাকা তারা পাবে না। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় থাকা পরিবারটি মুষড়ে পড়ে। নিজেদের কষ্টোপার্জিত টাকা এভাবে মুফতে হাতিয়ে নিলো বিমা কোম্পানিটি।
এদিকে চাঁদপুর উত্তর মতলব থানার পাঁচআনী গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী কর্মী বিপ্লব। ২০০৮ সালে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে ১০ বছর মেয়াদি একটি বিমা করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়া যান একটু ভালো থাকতে ও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। এরপর তার স্ত্রী নিয়মিত প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিতেন। এরই মাঝে তার পলিসি চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর যাবৎ প্রতিষ্ঠানটির মাঠকর্মীসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে ধরনা দিয়েও পাননি তার দাবির টাকা।
কোম্পানি থেকে কখনো বলা হচ্ছে, প্রিমিয়ামের কয়েক কিস্তির টাকা বাকি আছে। আবার কখনো বলা হচ্ছে কোম্পানির তহবিলে অর্থ নেই। কিন্তু বিপ্লব বলছেন, প্রিমিয়ামের কোনো বকেয়া কিস্তি নেই। অবশেষে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দেন ওই গ্রাহক। কিন্তু এখনও পাননি তার প্রত্যাশিত দাবির টাকা।
আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে অনুমোদন পায় একটি জীবন বিমা কোম্পানি। ব্যবসা বাড়াতে তারা উন্নয়ন কর্মকর্তাদের প্রিমিয়াম সংগ্রহের ওপর গাড়ি ও বিদেশ ট্যুরের অফার ঘোষণা করে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি ২০টি গাড়ি ক্রয় করে, যার প্রতিটির মূল্য ২০ লাখ টাকা ধরা হয়। এ জন্য প্রায় চার কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, প্রতিটি গাড়ির ক্রয়মূল্য ১৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে গাড়িপ্রতি পাঁচ লাখ করে মোট এক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
এছাড়া ট্যুর বাবদ ৩০ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও পরবর্তীতে জানা যায় এ বাবদ প্রকৃত খরচ ১২ লাখ টাকার কিছু বেশি। এখানেও প্রায় ১৮ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। শুধু ওপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোই নয়, দেশের বিমা খাতে এরচেয়েও মারাত্মক ঘটনা অহরহ ঘটছে। আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না কোম্পানিগুলো।
অপরদিকে খাতের উন্নয়ন ও অনিয়ম রোধে যে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব পালন করার কথা, তারাও প্রবিধান সম্পন্ন হয়নি, আইনে ফাঁকফোকর রয়েছে, জনবল সংকট, দক্ষ লোকের সংকট ও করোনার দোহাই দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। তবে খাত বিশ্লেষকরা অবশ্য এ নিয়ে বলছেন ভিন্ন কথা।
তারা জানান, বিমা কোম্পানিগুলোর পরিচালনায় যারা রয়েছেন, তারাই আবার নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানার সাথে জড়িত। এমনকি দেশের রাজনীতি ও সরকারব্যবস্থায়ও তারা ক্রীড়নক হিসেবে রয়েছেন। ফলে প্রভাবশালী ওইসব পরিচালকের বিরুদ্ধে সাধারণত যেতে চান না সরকারি কর্মকর্তারা। বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের থেকে নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন তারা। তাই বিমা খাত উন্নয়নে সরকারপ্রধানের নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
এক্ষেত্রে বিমা খাতের অনিয়ম রোধের ডিজিটাইজেশন বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিমা কোম্পানিতে অফিসিয়াল কাজ থেকে শুরু করে গ্রাহকের পলিসি করা, প্রিমিয়াম জমা, দাবি পরিশোধ ইত্যাদি কাজ যদি তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কমে যাবে এই অনিয়ম।
তারা আরও বলছেন, ডিজিটাইজেশন কী— সেটাই বিমা খাতের অনেকের ধারণা নেই। ফলে অনেক কোম্পানি শুধু একটি ওয়েবসাইট অথবা মোবাইলে প্রিমিয়াম জমার তথ্য দিয়েই মনে করছে ডিজিটাইজেশনের আওতায় চলে এসেছে। এসব কারণে অনিয়ম রোধ করা যাচ্ছে না।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক সময় দেখা যায় বিমা এজেন্টরা গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়ামের টাকা নিয়ে তা কোম্পানিতে জমা করেন না। কিন্তু ওই এজেন্ট পরে অপর একটি নম্বর দিয়ে গ্রাহকের নম্বরে প্রিমিয়ামের টাকা জমা হয়েছে— এমন এসএমএস পাঠায়। ফলে গ্রাহক নিশ্চিত হন তার টাকা জমা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। আবার ওয়েবসাইটে কোম্পানির গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় তথ্য অধিকাংশ সময়ে আপডেট থাকে না। এমনকি খোদ বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র ওয়েবসাইটই আপডেট নেই তথ্য।
মূলত এসব অনিয়ম প্রতিরোধে একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেইজ সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে সব কোম্পানিকে যুক্ত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও ব্যবহারিক দক্ষতাসম্পন্ন জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রতিটি কোম্পানি ইআরপি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমেও ধারাবাহিকভাবে অনিয়ম কমিয়ে আনতে পারে বলে তারা মনে করছেন।
এক্ষেত্রে চতুর্থ প্রজন্মের সোনালী লাইফ এবং গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে এগিয়ে রাখছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কার্যক্রম শুরুর পরপরই এ কোম্পানি দুটি কাগজবিহীন অফিস কার্যক্রম শুরু করে। ফলে কোম্পানি সব বিল-ভাউচার, হিসাব-নিকাশ, গ্রাহকসহ অন্যান্য যাবতীয় তথ্য তারা সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকে দক্ষ পলিসি সার্ভিস টিম। তারা কোনো গ্রাহক পলিসি করার আগেই তাকে পলিসির সুবিধা-অসুবিধাগুলো জানায়।
আবার পলিসি করার পর কোনো বিষয়ে গ্রাহকের আপত্তি থাকলে তা জেনে নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি করে। তাছাড়া গ্রাহককে প্রিমিয়ামের টাকা প্রদানের তারিখ মনে করিয়ে দেয়া এবং প্রিমিয়াম জমার পর নিশ্চিত করতে গ্রাহকের মোবাইলে এসএমএস দেয়া হয়। এজেন্টরা যেন মেসেজগুলো নকল করতে না পারে, সেজন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে
এসব মোবাইল মেসেজে। প্রিমিয়াম গ্রহণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহককে দেয়া হয় ই-রিসিপ্ট। এমনকি গ্রাহক পলিসির সব ধরনের তথ্য কোম্পানির ডাটাবেজে আপলোড থাকে বলে মাত্র এক দিনেই বিমা দাবি পরিশোধের উদাহরণ তৈরি হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রমে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বহুলাংশে কমে যায়।
বিমা খাতের উন্নয়নে এসব দিক বিবেচনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ থেকে বিভিন্ন সময়ে পরিপূর্ণ ডিজিটাল সেবা দিতে কোম্পানিগুলোকে চিঠি দেয়া হয়। এমনকি সোনালী লাইফকে দৃষ্টান্ত ধরে বিমা কোম্পানিগুলোকে এমন সফটওয়্যার বেইজড কার্যক্রমে আসতে নির্দেশনাও দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও পরিপূর্ণ সফটওয়্যার কার্যক্রমে আসেনি এ খাতের প্রায় শতভাগ কোম্পানি।
বিমা খাত পরিপূর্ণ ডিজিটাইজেশনে না আসার কারণ হিসেবে বিমাবিদ দাস দেবপ্রসাদ বলেন, একটি খাত যে লেভেলে গেলে উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে, আমাদের বিমা খাত এখনো সে পর্যায়ে আসেনি। এসব চালাতে যে দক্ষ মানবসম্পদ দরকার, তা নেই। হয়তো নতুন নতুন অনেকে বিমা ব্যবসায় আসছে; তারা এ বিষয়ে দক্ষ। কিন্তু আমাদের মানবসম্পদের বড় একটি অংশ আগের সময়ের।
তারা এ বিষয়ে কম্পিউটার বা তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখে না। এজন্য আইডিআরএকে শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না, পিছিয়ে থাকা মানবসম্পদকে হাতে-কলমে শেখাতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাহলেই এটা বাস্তবায়ন হবে।
এক্ষেত্রে সফটওয়্যার তৈরিতে ব্যয় বেশি বলে অনেকে উল্লেখ করলেও ভিন্নমত পোষণ করেন জেনিথ ইসলামি লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, আমার জানামতে বিমা খাতে চার-পাঁচটি কোম্পানি ইআরপি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে।
এর মাধ্যমে সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি রোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। আমরা নিজেরাও সোনালী লাইফের মতো ইআরপি সফটওয়্যার ব্যবহার করছি। এ বিষয়ে আইডিআরএর নির্দেশনা থাকলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনকে কঠোর হতে হবে। না হলে বিমা খাতের অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে না।
অপরদিকে সফটওয়্যার তৈরিতে ব্যয়ের বিষয়ে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও মীর রাশেদ বিন আমান বলেন, আমাদের সফটওয়্যারটি তৈরিতে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা প্রতিবছর নির্ধারিত ব্যয়সীমার চেয়ে অনেক কম ব্যয় করে ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করেছি। সর্বশেষ ২০২১ সালেও আমরা ব্যয়সীমার চেয়ে ৬১ কোটি টাকা কম খরচ করেছি।
তিনি বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় একটি সফটওয়্যারের পেছনে পাঁচ-ছয় কোটি টাকা ব্যয় অনেক বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, প্রতিবছরই আমরা নির্ধারিত ব্যয়সীমার চেয়ে বহুগুণ বেশি ব্যয় করছি শুধু ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা ও লোকবলের পেছনে। কিন্তু একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা ও কম লোক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা প্রতিবছরই গ্রাহকের কোটি কোটি টাকার সঞ্চয় সংরক্ষিত রাখতে পারি।
এছাড়া সফটওয়্যারের পেছনে যে ব্যয়, তা মাত্র এক বছরের মধ্যেই রিকভার করা সম্ভব। তবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও অনিয়ম পুরোপুরি রোধ সম্ভব নয় যদি কোম্পানির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের মানসিকতার পরিবর্তন না হয়— যোগ করেন তিনি।
দেশের বিমা খাতকে উন্নত দেশের বিমা খাতের পাশাপাশি দাঁড় করাতে দীর্ঘদিন যাবৎ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা বিমা খাতেও যেন বাস্তবায়ন হয়, সেজন্য বিভিন্ন সময়ই নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিমা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিমাকারী ও বিমা গ্রাহকদের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা প্রদান, বিমাকারী কর্তৃক বিমা গ্রাহককে প্রিমিয়াম রসিদ প্রেরণ (প্রিমিয়াম রসিদ লেখা বা প্রিন্টের জন্য শ্রমঘণ্টা, ডাক, কুরিয়ার ইত্যাদি) বাবদ খরচ সাশ্রয়, এ-সংক্রান্ত প্রিমিয়াম রসিদ ছাপানো ও হিসাব রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য জটিলতা নিরসন, সরকারি রাজস্ব ফাঁকি রোধ, বিমা পলিসি গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ বন্ধ, গ্রাহক হয়রানি রোধ, বিমা গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধি, সরকারের রূপকল্প ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অংশ হিসেবে সামগ্রিকভাবে বিমা খাতকে ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনা প্রয়োজন।