জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে পুরো দেশ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলেও সংকট কাটছে না দেশে। রিজার্ভ জ্বালানি সংকটে বিকল্প চিন্তা করছে সরকার। আমাদানি করতে চলছে নানা তদবির। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার ঠিক চার মাসের মাথায় দেশে তীব্র জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতার কথা জোরেশোরে বলা হয়েছে ইতোপূর্বে।
বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা আর উৎসবের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়েছে শতভাগ বিদ্যুতায়ন। অথচ এখনো দেশটির উৎপাদন ক্ষমতার বড় একটি অংশ নির্ভর করছে আমদানি করা জ্বালানির ওপর। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাচাই-বাচাই না করে তড়িঘড়ি করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলেই বড় সমস্যার মুখে পড়েছে বিদ্যুৎখাত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আমাদের অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তেল, কয়লা বা গ্যাস।
যার বড় অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়াকে এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
সেই সাথে দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়াকেও অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। দেশের ১৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অর্ধেকের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫৭টি কেন্দ্রের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ১১ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাসের উৎপাদন কম হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে এখন চাহিদার তুলনায় কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে এসব কেন্দ্রে অর্ধেকের কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
বিডিবি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি সংকটে সেটাও যোগান দিতে পারছেন না দেশের বিদ্যুৎ খাত। অন্যদিকে দেশে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সরকার এই ঘাটতি সমন্বয়ের চেষ্টা করছে।
এর আগে সরকার ২০৪১ সালে সর্বশেষ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এতে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে গ্যাসে ৩৫ শতাংশ, কয়লায় ৩৫ শতাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বাকি ৩০ শতাংশ তেল, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সক্ষমতা থাকলেও গড় উৎপাদন হচ্ছে ৯ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। কিন্তু জ্বালানি সংকটে সেটা ১১ হাজারে নেমে এসেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলছেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের জ্বালানি নীতির কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক জ্বালানির কোনো সমাধান হয়নি। টেকসই প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি।
এর ফলে বিশ্ববাজারে গ্যাস, তেলের দাম বাড়ার কারণে আমরা একটা অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি।’ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম আরও বলেন, বাংলাদেশে ২০০৫ সাল থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে গেলেও সেই ধারা ধরে রাখার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বাপেক্সের বিনিয়োগে যে আর্থিক ঝুঁকি নেয়ার দরকার ছিল, হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে শূন্য হাতে ফেরার যে ঝুঁকি ছিল, সেটি কোনো সরকারই নিতে চায়নি। ফলে দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি, বরং আমদানি করা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো হয়েছে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার বড় একটি অংশ নির্ভর করছে আমদানি করা জ্বালানির ওপর। দেশে চলমান তীব্র জ্বালানি সংকট কতদিন থাকবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের আগেই বিদেশি জ্বালানিনির্ভরতা কমানোর দরকার ছিল। তবে দেরি হলেও এখনই নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে নজর দেয়া দরকার।’ স্পট মার্কেটে দাম বাড়ায় জ্বালানির আমদানি সীমিত করেছে সরকার। এ বছরই এলএনজি আমদানি করতে সরকারে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এদিকে এলএনজি-নির্ভর বেসরকারি চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ শেষের দিকে রয়েছে, যেসব কেন্দ্র গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পেট্রোবাংলা। তবে সেই গ্যাস কোথা থেকে আসবে এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বর্তমানে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ না পাওয়ায় ডিজেলচালিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের দিকে জোর দিকে শুরু করে সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেখানেও বড় ধাক্কা এসেছে।
ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ১০টি, যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ২৯০ মেগাওয়াট। এর বাইরে ৬৪টি কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল। এসব জ্বালানির পুরোটাই আমদানিনির্ভর। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পেছনে প্রতি ইউনিট উৎপাদনে ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা খরচ হলেও সরকার বিক্রি করে মাত্র ৫ দশমিক ০৫ টাকায়। সব মিলিয়ে এই বছর বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘কয়েক মাসের মধ্যে আরও চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এ বিদ্যুৎ পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারতের আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসবে বলে তিনি লিখেছেন। এটি এখন জ্বালানি সংকটে বড় সম্ভাবনা।’
এদিকে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে দিনাজপুরের বড় পুকুরিয়ায় ও পায়রা কেন্দ্র। বড়পুকুরিয়া কয়লা দিয়ে সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চলে। অন্যদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কয়লাও আমদানি করা হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির উৎস হিসেবে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে কয়লা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ছিল। এ বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসের মধ্যে রামপালের, এস আলম গ্রুপের, আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হবে।
তখন বিদ্যুতের ঘাটতি অনেকটা কমে আসবে। সেই সাথে এই বছরের শেষে চট্টগ্রামের এক হাজার ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। বরিশালেও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষের পথে রয়েছে। কিন্তু এগুলোর সবগুলোর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা কয়লা আমদানি করতে হবে।
এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম আরও বলছেন, ‘দেশের ভেতর থেকে কয়লা উত্তোলনের যে পরিবেশগত ঝুঁকি ছিল, সেটি রাজনৈতিক কারণে সরকার নিতে চায়নি। ফলে আমদানি করা কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকি নিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে এখনো কয়লার দাম সহনীয় পর্যায়ে আছে। কিন্তু এর দাম বাড়া বা কমার কারণে জ্বালানি খাতের ওপর তো অবশ্যই প্রভাব পড়বে। দেশীয় সংকট সামলাতে সরকার বিদ্যুৎ আমদানির ওপর জোর দেয়ারও পরামর্শ দেন অনেক বিশেষজ্ঞ।’
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আমাদের ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে হচ্ছে।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ালে জ্বালানি সংকট কিছুটা কমবে। গ্রামাঞ্চলে ইতোমধ্যে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার অনেক বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশকে দেয়ার উদ্দেশে ভারতের ঝাড়খণ্ডে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করেছে আদানি গ্রুপ। তবে অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর চেয়ে এখানে বেশি দাম ধরা হয়েছে।
বিদ্যুৎ আসবে কোথা থেকে— এমন জিজ্ঞাসায় পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেছেন, ডিজেলের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় আমাদের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তবে সুখবর হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। এটা যদি সহনীয় জায়গায় আসে, তাহলে নিশ্চয়ই সরকার সেকেন্ড থট দেবে।
তবে যদি এই অবস্থাও থাকে, ধরুন, আমরা আপাতত আর ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করব না, আমাদের গ্যাস যতটুকু পাওয়া যায়, এর মধ্যেই থাকব। তাহলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হয়তো এরকম থাকবে। অক্টোবর থেকে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। কারণ ওয়েদার কন্ডিশন ভালো হলে কুলিং লোড কমে যাবে আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো (গ্রিডে) আসবে। সেপ্টেম্বর নাগাদ দেশীয় উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলা হলেও, সেটি এই নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসের আগে পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলছেন, বাংলাদেশে যেসব বড় কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে সেগুলোসহ রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে আসার পর ভাড়ায় চালিত কেন্দ্রগুলো থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
বর্তমান সংকট সম্পর্কে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এজাজ আরও বলেন, ‘শতভাগ বিদ্যুতায়ন জোর করে করা একটি ব্যাপার। শতভাগ বিদ্যুতায়নের সক্ষমতা আমাদের নেই। তড়িঘড়ি করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দিকে যাওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তাদের পুরো সম্পদ ও মনোযোগ সেদিকেই রাখতে হয়েছে। ফলে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন তখনই হবে, যখন আমরা উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রস্তুত হতে পারব। গ্রামের মানুষ তো শহরের মানুষের তুলনায় অনেক পরে বিদ্যুৎ পেয়েছে। আরও কিছুদিন অপেক্ষা তো তারা করতেই পারত। আমরা যদি পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করতাম, তাহলে কী ক্ষতি হতো? এখন তো সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো।’