রেল তার নিজস্ব পথে চলে, কাউকে ধাক্কা দেয় না। উল্টো অন্য যানবাহন রেল লাইনে এসে দুর্ঘটনা ঘটায়। এই একটি মাত্র দোহাই দিয়েই সারা দেশে রেলের বৈধ-অবৈধ সব লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটা সব দুর্ঘটনার দায় এড়াতে চায় রেল কর্তৃপক্ষ।
রেল কর্তৃপক্ষের এ মানসিকতা নতুন নয়। মন্ত্রী, সচিবসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তার অদল-বদল হয় কিন্তু এমন মানসিকতার আর বদল হচ্ছে না। আবার রেলের যে কঠোর আইন রয়েছে তা বাস্তবায়নেও অনীহা চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে।
গতকাল খোদ রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনও বলছেন, ‘রেললাইনে এসে কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে তার দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের নয়। ট্রেন কাউকে ধাক্কা দেয় না, বরং বাইরে থেকে এসে ট্রেনকে ধাক্কা দেয়া
হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আড়াই থেকে তিন হাজার কিলোমিটার রেললাইন তৈরি করছি।
যেখানে রাস্তা আছে সেখানেই ব্রিজ করা আছে। রেলে যে আমরা বেরিয়ার দেই, গেট দেই— এ গেটটা দেয়া হয় যাতে রেলের কোনো ক্ষতি না হয়। রেল ঠিকভাবে চলতে পারে, বাইরে থেকে কোনো কিছু যেন রেলের ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু কেউ যদি এসে রেলগেটে কিংবা রেললাইনে দুর্ঘটনার শিকার হন তার দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের নয়।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্যকে দায়সারা বলছেন অনেকেই।
শুধু চট্টগ্রামের মিরসাইয়ের ঘটনার বিষয়েও যদি বলা হয় তাহলে তাতে রেল কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানোর চেষ্টা অনেকটাই স্পষ্ট। আর সেটি স্পষ্টের নায়ক স্বয়ং ঘটনার দিন বার না ফেলেই জুমার নামাজে যাওয়া সেই গেটম্যান সাদ্দাম হোসেন। ঘটনার দিন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেনও জোরালো স্বরে বলেছিলেন, মাইক্রোবাসটি যখন রেললাইনের কাছে পৌঁছায় তখন গেট ফেলা ছিল।
খৈয়াছড়া এলাকায় রেলওয়ের ওপর দিয়ে একটি সড়কপথ গেছে। সেখানে রেলওয়ের নিযুক্ত গেটম্যানও আছে। দুর্ঘটনার পরপর গেটকিপারের সাথে কথা বলেছি। গেটকিপার আমাকে জানিয়েছেন, ট্রেন আসার আগেই গেট ফেলা ছিল। কিন্তু মাইক্রোবাসের চালক গেটবারটি জোর করে তুলে রেললাইনে প্রবেশ করেন। এরপর মহানগর প্রভাতী ট্রেন মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দেয়। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি। অথচ ঘটনার ঠিক দুদিন পরই অনুতপ্ত হয়ে সেই গেটম্যান নিজেই তদন্ত কর্মকর্তার কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তিনি দুর্ঘটনার সময় নামাজে ছিলেন এবং গেট বারটিও ফেলে যাননি।
তার এমন স্বীকারোক্তির পর স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে কীভাবে এবং কেন ঘটনার দিন মহাব্যবস্থাপক জোরপূর্বক গেটবার তুলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ওঠার মতো ভিত্তিহীন জোরালো দাবি তুলেছিলেন? যেখানে গেটম্যানই বলছেন, সেদিন বারই ছিল না সেখানে।
জোরজবরদস্তির ঘটনাই বা কখন কীভাবে ঘটল? একইভাবে গতকাল গোপালগঞ্জে দেয়া রেলপথমন্ত্রীর বক্তব্যেও এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ১১ জন সেদিন মারা গেছে, তাদের মৃত্যুর দায় এড়াতেই এত ছলাকলা। বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন, মিরসরাইয়ের ওই লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার সময় রেলওয়ের নিযুক্ত গেটম্যান থাকলেও ঘটনার সময় ছিলেন না ও গেটবারও ছিল না।
এরপরও কেন মৃত ব্যক্তিকেই দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে— এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ না করেই কেটে দেন। পরে একই প্রশ্ন উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া মেলেনি।
এদিকে ঘটনার দিন মিরসরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর রহমান আমার সংবাদকে বলেছিলেন, দুর্ঘটনার সময় সেখানে গেটকিপার সাদ্দাম হোসেন উপস্থিত ছিলেন না। দুর্ঘটনার সময় তিনি জুমার নামাজে ছিলেন এবং ক্রসিংবারও ফেলে যাননি। ঘটনার দুদিন পর গতকাল সোমবার গেটম্যান সাদ্দাম হোসেন ওইদিন দুপুরে দুর্ঘটনার সময় তিনি জুমার নামাজে ছিলেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। এমনকি গেটবারও ফেলে যাননি বলে স্বীকার করেছেন। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সীতাকুণ্ড রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ খোরশেদ আলম এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘গেটকিপার সাদ্দাম হোসেন স্বীকার করেছেন, তিনি ঘটনার সময় ছিলেন না। তিনি তখন জুমার নামাজে ছিলেন। লেভেল ক্রসিংয়ের বারও (ব্যারিয়ার) ফেলা ছিল না। এ জন্য অনুতপ্ত হয়ে তিনি ভুল স্বীকার করেছেন।’ পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাদ্দাম যেহেতু স্বীকার করেছেন সে জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হয়নি। যেহেতু আসামি একমাত্র সাদ্দাম, সে জন্যও প্রয়োজন হয়নি।’ এদিকে ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে তারাও প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই দুপুরে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া এলাকায় মহানগর প্রভাতী ট্রেন ও পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ১১ জন নিহত হন। তারা হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে গিয়েছিলেন। ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও ছয়জন আহত হন। অভিযোগ ওঠে, গেটম্যান সাদ্দামের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। লেভেল ক্রসিংয়ের বারও (ব্যারিয়ার) ফেলা ছিল না। ঘটনার সময় জুমার নামাজ পড়তে সাদ্দাম মসজিদে ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।