করোনা অভিঘাত পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় দেখা দিলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এর ফলে নানামুখী সংকটে পড়ল পুরো বিশ্ব। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে জ্বালানি খাতে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বেছে নেয়া হয় লোডশেডিংসহ নানা সাশ্রয়ী নীতি।
এদিকে দেশে জ্বালানির দাম বাড়ার গুঞ্জন উঠেছে চারদিকে। এছাড়া আগে থেকেই বলা হচ্ছে, সরকার জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি গুনছে।
বিপিসি বলছে, তাদের দৈনিক ১০০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়। তাছাড়া জ্বালানির দাম বাড়ার ইঙ্গিত দেন খোদ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ করেই জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে।
সূত্র বলছে, জ্বালানির মূল্য সমন্বয় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তবে এখনো কিছু নির্ধারিত হয়নি। সমপ্রতি প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা চলছিল। আবার অনেকে বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের লোকসান পোষানো সম্ভব নয়। লোকসানের দায় কে নেবে? সরকার চায় সমন্বয় করতে। এই সমন্বয়ের অর্থ হতে পারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি। আর এর দায় চাপবে জনগণের ওপর।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিকসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে জ্বালানির দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডিজেলে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে। যার কারণে ডিজেলের দাম বেশি বাড়বে। সেটা হয়তো লিটারপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা হতে পারে।
সমপ্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও বিভিন্ন সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপিসির দৈনিক লোকসান হচ্ছে প্রায় শতকোটি টাকা। বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেলের যে মূল্যবৃদ্ধি, তা অস্বাভাবিক। এটি আসলে কত দিন চলবে, সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমরা সমন্বয় করার চিন্তা করছি। এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমায় সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে কি-না তাই দেখার বিষয়।
বিপিসির সূত্র অনুযায়ী, বছরে ৬২ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ ডিজেল, ৪.৮ শতাংশ অকটেন, ৬ শতাংশ অপরিশোধিত তেল।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে। গতবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর হিসাবের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি বাড়ানো হয় পরিবহন ভাড়া। সঠিক পরিকল্পনা না নিয়ে হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ালে জনজীবনে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ পড়বে। তবে বিশ্ববাজারে এবার কমল জ্বালানি তেলের দাম।
গত জুলাই মাসে চীন ও জাপানে কারখানায় উৎপাদন কম হওয়ার কারণেই তেলের দাম কমেছে বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে বিশ্বের তেল রপ্তানিকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেক এবং অন্যান্য বড় তেল উৎপাদনকারী দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলতি সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ কমে হয়েছে ১০৩ দশমিক ১৫ ডলার এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুড তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১ দশমিক ১৮ ডলার বা ১ দশমিক ২ শতাংশ কমে হয়েছে ৯৭ দশমিক ৪৪ ডলার।
গত জুনে উৎপাদনের গতি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল বিশ্বের বৃহত্তম ক্রুড তেল আমদানিকারক দেশ চীনে। কিন্তু দেশটিতে করোনা সংক্রমণ ফের বাড়তে থাকায় নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এতে জুলাইয়ে প্রত্যাশার চেয়ে কম উৎপাদন হয়েছে।
মার্কেট ম্যানুফ্যাকচারিং পার্চেসিং ম্যানেজারস ইনডেক্সে (পিএমআই) গত জুনে চীনের পয়েন্ট ছিল ৫১ দশমিক ৭। কিন্তু গত মাসে এই পয়েন্ট কমে হয়েছে ৫০ দশমিক ৪। অপরদিকে জাপানে গত ১০ মাসের মধ্যে জুলাইয়ে সবচেয়ে কম উৎপাদন হয়েছে।
সিএমসি মার্কেটসের বিশ্লেষক টিনা টেং বলেন, আজ তেলের দাম কমার প্রথম ও মূল কারণ চীনের উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে কমে যাওয়া।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের এই দাম বেশি দিন থাকবে না এটাই স্বাভাবিক কথা। বিশ্ববাজারে দাম কমলে সরকারকে অবশ্যই দাম কমিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের পরিচালক (পেট্রোলিয়াম) ড. মো. দিদারুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের দেশের জ্বালানির অধিকাংশই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে আমাদের দেশেও কমবে আর বিশ্ববাজারে বাড়লে আমাদের দেশেও বাড়বে। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায়, আমাদের জ্বালানির দাম অনেকটা বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভর করবে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে এমতাবস্থায় আমাদের দেশে কমবে কি-না এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, এখনই বলা যাচ্ছে না জ্বালানির তেলের দাম বাড়বে কি কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এক লাফে অনেক বেড়ে যাওয়ায় আমদানি করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সব মহলে দাম বাড়ানোর কথা হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ বিশ্ববাজারে তেলের দরপতনে আমাদের আবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা বসব। শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে উৎপাদন কমে যাবে। এমনকি সময়মতো বাজারে পণ্য সরবরাহেও ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এজন্য উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখতে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী সব প্রতিষ্ঠানকে লোডশেডিংয়ের আওতার বাইরে রাখতে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব খন্দকার নুরুল হক স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি সমপ্রতি বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, আমাদের এখন ডিজেল ও অকটেন বিক্রিতে দৈনিক প্রায় ৯০ কোটি টাকার মতো লোকসান দিতে হচ্ছে। ডিজেল ও অকটেন বিক্রিতে গত পাঁচ মাসে (ফেব্রুয়ারি-জুন) সাত হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এখন বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে ডিজেলে। এক লিটার ডিজেল কিনতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১২৭ থেকে ১২৮ টাকা, কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০ টাকায়। এই টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।