বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার গত বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। একদিকে আমদানির চাপ, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ।
আমদানির চাপ নিরসনে কাজ করার সুযোগ না থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোরালোভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করেন তিনি। সেদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের ডেকে দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করার কথা জানান গভর্নর।
এর পরদিন শুক্রবার দেশের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ফলে মুদ্রাস্ফীতি আট থেকে বেড়ে ডাবল-ডিজিটে চলে যেতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
পরিবহন, কৃষি খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ডিজেল বেশি ব্যবহার হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে রপ্তানি আয় ও জিডিপিতে বড় আঘাত আসবে। এছাড়া নানামুখী প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে যে অসহনীয় চাপ তৈরি হবে তা সামাল দেয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমছে, তখন দেশের ইতিহাসে এক লাফে রেকর্ড পরিমাণে দাম বাড়িছে সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি (৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে তাদের শর্ত পূরণ করতে সারের পর তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, আইএমএফের ঋণের প্রধান শর্তই ছিল সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে। সেই শর্ত মেনেই তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তবে একসাথে এতটা বাড়ানো উচিত হয়নি। হুট করে এত বেশি দাম বাড়ানোর চাপ অর্থনীতি নিতে পারবে না বলে মনে করছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, আইএমএফের ঋণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘোষণা আসতে পারে। সারের পর তেলের দাম বাড়ানোয় এখন আমাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না, ঋণ পেতেই আইএমএফের কথামতো তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিল। তবে সেটি সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা চিন্তার বাইরে।’
জ্বালানি তেলের দাম অপ্রত্যাশিত হারে বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, এর ফলে সব কিছুর দাম আরও বেড়ে যাবে।
এমনিতেই ৮ শতাংশের কাছাকাছি মুদ্রাস্ফীতি। এটা ডাবল ডিজিটে চলে যেতে পারে। এমনিতেই মানুষ কষ্টে আছে, মানুষের জীবনধারণ আরও কষ্টকর হয়ে যাবে। দাম বাড়ার সাথে সাথে পরিবহন ব্যয় বাড়বে। সব পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। ফলে সরকারের যত অর্জন সব ম্লান হয়ে যেতে পারে।
পরিবহন সেক্টরে অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির আগেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম। তিনি তেলের দাম বৃদ্ধিকে কোনো যুক্তিতেই সমর্থন করেন না।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে এখন তেলের দাম পড়তির দিকে, এ সময় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করার দরকার ছিল না। আর এত বৃদ্ধি তো আদৌ দরকার ছিল না। এর ফলে প্রচণ্ড মুদ্রাস্ফীতি হবে। এর প্রভাব অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে কেমন পড়বে সেটা সময়ই বলে দেবে। এখন না বাড়ালেও হয়তো সামান্য কিছু ভর্তুকি দিতে হতো।
সরকার অতীতেও ভর্তুকি দিয়েছে। যেখানে আমরা দেখতে পারছি বিশ্ববাজারে দাম কমে আসছিল। সামনে আরও দাম কমবে। আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নেয়ার শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ।
দাম বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সামপ্রতিক বছরগুলোর হিসাবে সর্বোচ্চ।
সেটা সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে বলে আশঙ্কা করা যায়। মূলত পরিবহন, কৃষি খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ডিজেল বেশি ব্যয় হয়। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ভোক্তার ওপর পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসবে।
তেলের দাম বাড়ানোয় টিকে থাকা কষ্টকর হবে বলে জানিয়েছেন দেশের তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। আমার সংবাদকে তিনি বলেন, পুরোনো অর্ডারগুলোতে প্রচুর লোকসান হবে। অনেক কারখানা নতুন অর্ডার নিতে পারবে না। ফলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
এই মুহূর্তে কারখানায় গ্যাংস সংকট চলছে। সরকার নির্দেশিত লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ থাকে না পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। এ কারণে দিনে ছয় ঘণ্টার জন্য জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ায় জ্বালানি তেলও বেশি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
কারণ, আমাদের হাতে প্রচুর কাজের আদেশ (অর্ডার) রয়েছে। বড় অঙ্কের লোকসান দিয়ে এখন ওই (অর্ডারের) পণ্য উৎপাদন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দেশে পরিবহন ভাড়া বাড়বে, ট্রাক ভাড়া বাড়বে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি। এসবের সঙ্গে শ্রমিকদের বেতনও বাড়াতে হবে। লোকসান থেকে বাঁচতে চাইলে অনেক কারখানা বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এভাবে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি হলে সেটা সমন্বয় করবে। তাই বলে কী এক সাথে ৪৪-৫১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি? এটি অস্বাভাবিক, এটি হতে পারে না।
পোশাক খাতে প্রভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমত পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য যে পরিবহন ব্যবহার করি, সেই পরিবহন কস্ট আজ (শবিবার) থেকে বেড়ে গেছে। এমনিতেই তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ানো হয় ২০ শতাংশ। এখন ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। এবার যে কত শতাংশ বাড়াবে তা সহজে অনুমান করা যায়। যাতায়াত ভাড়া বাড়লে আমদানি-রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দুদিন পর বিদ্যুতের মূল্য আবারো বৃদ্ধির জন্য যৌক্তিকতা আসবে। আর বিদ্যুতের মূল্য আবারো বাড়ানো হলে সরাসরি আমাদের ওপর আসবে। তখন আরেকটি ইফেক্ট পড়বে।
প্রসঙ্গত গত শুক্রবার রাত ১২টার পর জ্বালানি তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা ও অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে।