লোকমান হোসেন। ফেনী থেকে স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে। মানিক নগর নেমে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে কোনো গাড়িতে উঠতে পারেননি। অবশেষে একটি অফিস বাসকে থামিয়ে সমস্যার কথা জানিয়ে কোনোমতে গাড়িতে উঠেন।
তিনি জানান, তিন দিন আগে ঢাকার পান্থপথে একটি হাসপাতালে সকাল সাড়ে ১০টায় ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়েছেন। কিন্তু মানিক নগর সকাল সাড়ে ৮টায় নেমে বাস, মাইক্রো, সিএনজি এবং কী কোনো রিকশাই খুঁজে পাননি। আর দুটো রিকশা পেয়েছেন তারা ১২০ টাকার ভাড়া আড়াইশ টাকা হাঁকান। একটি সিএনজি পেয়েছেন দেড়শ টাকার ভাড়া চাইল ৪০০ টাকা।
লোকমান বলেন, ‘অবশেষে আমাদের বয়স্ক দুজনকে বিপর্যস্ত পরিস্থিতে দেখে একটি ব্যাংকের স্টাফ বাসের লোকজন আমাদের সাহায্য করেন। তারা আমাদের কারওয়ান বাজার পর্যন্ত নামিয়ে দেন।
জানা যায়, গতকাল শুক্রবার রাত ১২টার বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এর ফলে শনিবার সকাল থেকে সংকট দেখা দিয়েছে রাজধানীতে গণপরিবহনের। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন কর্মস্থলগামী মানুষ। বাস স্টেশনগুলোতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়ি না পেয়ে অনেকে হেঁটে রওনা দিয়ে কর্মস্থলে গেছেন।
আবার অনেকে বাদুড়ঝোলা হয়ে কর্মস্থলে পৌঁছেছেন। সকাল সাড়ে ৮টায় মানিকনগর, টিটিপাড়া মোড়ে দেখা গেছে কয়েকশ যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ কোনো বাহন পাচ্ছেন না। নিয়মিত যে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকত সেগুলো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। দু’-একটা রিকশা আছে তারা চার-পাঁচগুণ বেশি ভাড়া চাচ্ছে।
টিটিপাড়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আবদুল্লাহ বলেন, আমার দু’-একটি ব্যাগ আছে বহন করতে কষ্ট হচ্ছে। এখান থেকে দক্ষিণ কমলাপুর থেকে ভাড়া হচ্ছে ২০ টাকা আর রিকশা তার ভাড়া চাচ্ছে ৬০ টকা।
এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সকাল সাড়ে ১১টায় পুরানা পল্টন, বিজয়নগর, কাকরাইল, নয়াপল্টন এলাকায় গণপরিবহন দেখা যায়নি। রাস্তায় আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তিন-চারটি বাস চোখে পড়েছে মাত্র। মানুষজন বিরক্ত হয়ে শুধু হাঁটছে। তবে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা কিছুটা দেখা গেছে।
সেগুলোতে সাধারণ যাত্রীদের উঠা দুঃসাধ্য। পুরানা পল্টনে দাঁড়িয়ে থাকা আদিব জামাল বলেন, আমি এখান থেকে হাতিরঝিল যাবো। ওরা যা ভাড়া চাচ্ছে তাতে আমার এক দিনের সংসার খরচ। তাই কষ্ট হলেও হাঁটছি। সকাল ৮টা থেকে গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মৌচাক এলাকাতেও একই চিত্র ছিল বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, শুক্রবার রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জ্বালানি তেলের নতুন দর জানানো হয়।
ভোক্তা পর্যায়ে (ডিপোর ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে) ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রোলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন কিনতে লাগবে ১১৪ টাকা। এ ছাড়া এক লিটার অকটেনের জন্য ভোক্তাকে দিতে হবে ১৩৫ টাকা আর প্রতি লিটার পেট্রোল ভোক্তা পর্যায়ে কিনতে হবে ১৩০ টাকায়।
ভাড়া বাড়ায় দুর্ভোগ নিয়ে আবদুল্লাহ রায়হান বলেন, এক ঘোষণায় ভাড়া বেড়ে গেছে দ্বিগুণ! সাইনবোর্ড থেকে ঢাকা মেডিকেল ভাড়া ঠিকানা, মৌমিতায় ২০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা। এ রকম সব জায়গায়। সঙ্গে খারাপ ব্যবহার বোনাস! মানুষ হিসেবে যেন স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি। ক্ষোভ প্রকাশ করে মনিমালা মণ্ডল বলেন, উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ। বন্যার পানি ঢুকে সিলেট শেষ। পদ্মা সেতুর উৎসবে মেতেছে দেশ। এই দিকে দ্রবমূল্যর দাম বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত শেষ। এটাই সোনার বাংলাদেশ।
যোয়েন্তা চক্রবর্তী বলেন, পাঠাও তে গতকালকের চাইতে প্রায় ৪০ শতাংশ ভাড়া বেশি দেখাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। অফিসে যাওয়ার জন্য যে রাস্তায় পাঁচ মিনিটে অন্তত একটি বাস পেতাম সেখানে আজ ৩০ মিনিটে মাত্র দুটি বাস পেয়েছি। বাদুড়ঝোলা শব্দটাকে ভুলতে বসেছিলাম। আজকে নিজেই বাদুড়ঝোলা হয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ভাড়া বেশি দিয়ে অফিসে এলাম। উন্নয়নের প্রভাবে আমাদের জীবনটা শেষ।
নিত্য মণ্ডল বলেন, গত এক বছরে সব কিছুর দাম যে হারে বেড়েছে। অপরদিকে, বেতনের মাত্রা ঠিকই স্থিতিশীল রয়েছে। কোম্পানিগুলো প্রোডাক্টের মূল্য বৃদ্ধি করেছে, বাসার মালিক ভাড়া বাড়িয়েছে, যানবাহনের ভাড়াসহ প্রায় সব সেবার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট চাকরি করা মানুষ, রিকশাচালক, শ্রমিক যারা বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করুন তাদের জীবন-যাপন সম্পর্কে।
সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে রাজধানীর মিরপুর রোডে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক মজনু বলেন, সকাল থেকে রাস্তায় গণপরিবহন খুব কম। রাস্তায় শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু গাড়ি নেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।