কোনো রকমের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বন্ধের দিন (গেল শুক্রবার) মধ্যরাতে হঠাৎই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তাও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার অনেকটাই বাইরে। যে কারণে সঙ্গে সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সিদ্ধান্তে অটল সরকার। আর এখন এই সিদ্ধান্তেরই বহুমুখী প্রভাবের শিকার দেশের মানুষ। এর একটি গণপরিবহন।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে গণপরিবহনে ভাড়াও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্ধিত ভাড়ার মাত্রা সীমার মধ্যে থাকলেও আদায়ের ক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়েছে গণপরিবহনের চালক-হেলপাররা। আর এর নির্দেশদাতা পরিবহন মালিকরা।
যে কারণে বর্ধিত ভাড়া কার্যকরের প্রথম দিন গতকাল রোববারের পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, বাসে বাসে চালক-হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের বাগবিতণ্ডা, হাতাহাতি, ঝগড়াঝাটি। নানা কারণ দেখিয়ে যাত্রীরা বর্ধিত ভাড়া দিতে নারাজ, চালক-হেলপাররাও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও বর্ধিত ভাড়ার দোহাই দিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায়ে অনড়।
শুধু তাই নয়, ভাড়া বাড়ানোর পরও রাজধানীতে গণপরিবহনের সংকট কাটেনি। গতকালও গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে বাসের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। যার ফলে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ভোগান্তিতে পড়তে হয় অফিসগামী যাত্রীদের।
অথচ বিআরটিএ ও পরিবহন মালিকদের বৈঠক থেকে ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা আসে শনিবার রাতে। গতকাল থেকে নতুন ভাড়া কার্যকরের কথা জানানো হয়। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত মেনে বাস চালানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন করছেন প্রতারণা।
সড়কে পরিবহন কম, যাত্রী ভোগান্তি : রাজধানীর রায়েরবাগ থেকে মতিঝিলের অফিসে যাবেন সুমন (ছদ্মনাম)। অন্যান্য দিনের মতো গতকাল সকালেও এই রুটের বাস হিমালয়ে উঠতে যেতেই কন্ডাকটর জানান ভাড়া ২৫ টাকা। অথচ এই রুটেই এতদিন ১০-১৫ টাকা ভাড়া দিয়ে চলাচল করতেন তিনি।
তাই কন্ডাকটরের বাড়তি ভাড়ার কথা শুনে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি। সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ দেন। একইভাবে ওই রুটে চলাচল করা ঠিকানা পরিবহন, মৌমিতা পরিবহন, এসএম লাভলী পরিবহনসহ সবকটিরই এক অবস্থা। বাড়তি আদায়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াচ্ছে। তাও পাঁচ টাকা কম নেয়ার মানসিকতা দেখা যাচ্ছে না তাদের।
বেশি ভাড়া আদায়ের কারণ জানতে একাধিক বাসের কন্ডাকটররা বলেন, মালিক নিতে বলছে, তাই নিতেছি। ভাড়া তো সরকার ঠিক করে দিয়েছে, তারপরও মালিক কেন বেশি নিতে বলবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলছে, ভাড়া বাড়ছে এমন কিছু জানি না। তবে জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিলে আমরাও ভাড়া কমিয়ে দেব। ক্ষুব্ধ যাত্রীরা বলছেন, যতক্ষণ না ভাড়ার চার্ট লাগাবে ততক্ষণ বেশি ভাড়া দেবেন না তারা।
আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না নিম্নআয়ের মানুষের : গতকাল রোববার সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, নিম্নআয়ের প্রায় সব মানুষের মুখে এখন একই কথা। সাধারণ মানুষ বলছেন, আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ছেই। গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি তাদের জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে এই বাড়তি খরচ সমন্বয়ের কোনো উপায় না দেখে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন তারা।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, মালামাল কেনার জন্য তাদের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যেতে হয়। কিন্তু এখন যাতায়াত খরচ বেড়ে যাবে। এ নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বলছে, তেলের দাম বাড়লেও তাতে পরিবহন মালিকদের মাথা ব্যথা নেই। তাদের কিছু যায়-আসে না। তারা প্রতিবাদও করে না।
কারণ, তারা তো সাধারণ যাত্রীদের পকেট কাটতে পারবে। ঢাকার বাইরে থেকে এসেও অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। ব্যক্তিগত কাজে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছেন খোকন। আসার পথেও বাড়তি ভাড়া দিতে হয়েছে তাকে। গতকাল সারাদিন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। দিনশেষে তার বাড়িতে ফেরার টাকা শেষ হয়ে যায়। পরে পরিচিতদের ফোন করে ভাড়ার টাকা মিলিয়ে কুমিল্লায় ফিরেন তিনি।
কোনো বাসেই নেই ভাড়ার তালিকা : নিয়ম অনুযায়ী নতুন করে ভাড়া নির্ধারণের পর সড়কে বাস নামলে তাতে ভাড়ার তালিকা থাকার কথা। কিন্তু নতুন ভাড়া নির্ধারণের পরদিন গতকাল একাধিক গাড়িতে উঠে দেখা গেছে কোনোটাতেই তালিকা নেই। এমনকি পুরান তালিকাও তুলে ফেলা হয়েছে।
গাজীপুর রুটের আজমেরী, টঙ্গী-গাজীপুরা রুটের ভিক্টর পরিবহন, সাভার রুটের সাভার পরিবহন, মিরপুর রুটের বিহঙ্গ ও তানজিল পরিবহন, মিডলাইন, ট্রান্স সিলভা পরিবহন, নগর পরিবহনের একাধিক গাড়িতে উঠে দেখা গেছে, কোনোটাতেই নতুন ভাড়ার তালিকা নেই। এমনকি রাষ্ট্রীয় পরিবহন বিআরটিসির বাসেও লাগেনি ভাড়ার তালিকা।
বাস শ্রমিকরা বলেন, এখনো মালিকদের পক্ষ থেকে ভাড়ার তালিকা কবে দেয়া হবে সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। অবশ্য বিআরটিসি বাসের কন্ডাকটর জানিয়েছেন, রোববার বিকেল থেকেই তালিকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
অন্য একটি বাসের চালক বলেন, ভাড়ার তালিকা কখন দেবে কিছুই জানি না। মালিক বলছে, ২০ টাকার ভাড়া ২৫ টাকা আর ৪০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা নিতে। যদিও বিআরটিএ এবং বাস মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাড়তি ভাড়া নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাসভাড়া বেশি নিলেই ব্যবস্থা, মাঠে বিআরটিএর ১০ টিম : দেশে কোনো কারণে নতুন ভাড়া নির্ধারণ হলেই বেশিরভাগ সময়ে বাড়তির চেয়েও বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রবণতা থাকে শ্রমিকদের। সেজন্য ওয়েবিলের নামে যাত্রীদের পকেট কাটা বন্ধ, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও নতুন ভাড়া যথাযথভাবে কার্যকর করতে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিএ) ১০টি টিম।
গতকাল সকাল থেকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন সংস্থাটির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। যদিও গুলিস্তান-পল্টন-প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগ এলাকায় কোনো অভিযান দেখা যায়নি গতকাল।
তবে বিআরটিএর পক্ষ থেকে বিমানবন্দর এলাকায় অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ার বলেন, কিলোমিটার প্রতি দুই টাকা ৫০ পয়সার বেশি ভাড়া নেয়া যাবে না। যারা নেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভাড়ার তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক বাসে অন্তত চারটি জায়গায় ভাড়ার তালিকা থাকতে হবে। না হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সঠিক ভাড়ার খবর জানেন না চালক-কন্ডাকটররা : সবশেষ গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে দূরপাল্লার বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে এক টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছিল। একই সময়ে মহানগরে বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে দুই টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছিল।
গত শুক্রবার তেলের দাম আবার বাড়ানোর কারণে নতুন করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। দূরপাল্লার যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা ও মহানগরে ৩৫ পয়সা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল ছিল নতুন ভাড়া কার্যকরের প্রথম দিন।
শনিবার বাস মালিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) দীর্ঘ বৈঠক করে এই ভাড়ার ঘোষণা দিলেও গতকাল একাধিক পরিবহনের চালক-কন্ডাকটরদের সঙ্গে কথা বললে কিলোমিটারে কত ভাড়া বাড়ল তা বলতে পারেননি তারা।
মতিঝিল এলাকায় গাজীপুর পরিবহনের একটি বাসের চালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিলোমিটার প্রতি কত ভাড়া বাড়ল সেটা বলতে পারব না। মালিক বলছে সকল ভাড়ায় ১০ টাকা বাড়তি নিতে।
ওয়েবিলে পকেট কাটা চলছে : বিআরটিএর পক্ষ থেকে যাত্রীর হিসাব রাখার কথা বলে বাস মালিকদের করা ওয়েবিলকে অবৈধ বলা হচ্ছে। অথচ বছরের পর বছর ধরে এই পদ্ধতিতে যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। প্রতিবার ভাড়া বাড়ানোর সময় এ নিয়ে কথা উঠলেও ওয়েবিল বন্ধ হয় না। এবারও ভাড়া বাড়ানোর সময়েও বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে এ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।
ওয়েবিলকে অবৈধ জিনিস আখ্যা দিয়ে চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটরা এ ধরনের অনিয়ম দেখতে পেলে তাদের আইনের আওতায় আনেন। জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করব, তাদের যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, তারা যেন ভাড়া মনিটর করেন। যাতে কেউ বাড়তি ভাড়া আদায় করতে না পারেন।’