উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বাঁচতে দেশে দেশে অস্থিরতা। ঠিক এমন সময়ই জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে চরম মূল্যস্ফীতের দিকে ঠেলে দেয়া হলো দেশকে। জ্বালানি খাতে মূল্যস্ফীতের হার ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর ফলে প্রভাব পড়ছে খাদ্য, কৃষি, পোশাকসহ উৎপাদনশীল সব পণ্যে।
নিত্যপণ্যে জ্বালানির উত্তাপে পুড়ছে জনগণ। জনজীবনে দুঃখ-দুর্ভোগ-অসন্তোষ চরমে। রাজধানীর কাঁচাবাজারে প্রায় সব ধরনের সবজি, চালসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ২০ শতাংশ। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে এসব প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পরিবহন ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এ কারণে পাইকারি বাজারেই সবজির দাম কেজিতে আট থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। একই অজুহাতে ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়িয়েছেন মুরগি ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা ও আড়তদারদের মাঝে বািবতণ্ডাও দেখা গেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিমারি করোনার ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন এমনিতেই সংকটে পড়েছে, এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আগে থেকেই অস্থির দেশের বাজার। এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে এখন বাড়ছে সব কিছুর দাম। কারণ জ্বালানির ওপর নির্ভর করছে যাবতীয় উৎপাদন। এদিকে ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়িয়েছে সরকার। এর ফলে কৃষককে প্রতি কেজি সার ১৬ টাকার পরিবর্তে কিনতে হবে ২২ টাকায়। শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধি প্রায় ৩৮ শতাংশ।
আর একজন ডিলার পর্যায়ের দাম ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এ ছাড়াও ইউরিয়ার ব্যবহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এ সিদ্ধান্ত।
জ্বালানির দাম বাড়ার ফলে উৎপাদনশীল সব পণ্যের দাম বাড়বে আরেক ধাপ। পোশাক কারখানা, বেকারি পণ্য, কৃষিসহ সব ধরনের পণ্যে পড়বে এর প্রভাব। চলতি আমন মৌসুমে অন্যন্য বছর বৃষ্টি হলেও এবার কৃষকদের নির্ভর করতে হবে সেচের পানির ওপর।
সুতরাং সবজির দামও বাড়বে অনেক। খুচরা বিক্রেতা সবজি বিক্রেতা বলেন, পাইকারিতে হঠাৎ করে সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরাও বেশি দামে বিক্রি করছি। আলু, পেঁয়াজ, আদার দাম বেড়েছে।
কাঁচামরিচের দাম ১৫ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে। তেলের দাম বাড়ার কারণে জিনিসের দাম বেড়েছে বলে জানান তিনি। কারওয়ান বাজারে সবজি নিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে আসা এক ট্রাক ড্রাইভার বলেন, আমার ট্রাক তিন টনের। এতে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার সবজি আনতে পারি।
আগে ঢাকায় পণ্য আনতে ভাড়া ছিল পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। এখন সেই ভাড়া সাত থেকে আট হাজার টাকা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, কত দামে বিক্রি হবে সবজি। তেলের বাড়তি দামসহ অন্য খরচ ধরলে এখন সেই ভাড়া হয়েছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এ কারণে আমাদের ট্রিপও কমে গেছে। অনেকেই বেশি দামে ভাড়া নিতে চাচ্ছে না।
ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, এখন যতটা না বেড়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তা আরও বেড়ে যাবে। আজকে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কিনতে পারলেও কাল থেকে হয়তো কাঁচকলার হালি কিনতে হবে ৫০ টাকায়। বেড়েছে মুরগির দামও। ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি ব্রয়লারে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা বিক্রি করছেন।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে মাছের বাজারেও। কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব ধরনের মাছের দামও বাড়তি। সবজি বিক্রেতাদের মতো মাছ ব্যবসায়ীদেরও একই যুক্তি। বর্তমানে মোটা জাতের ইরি-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৫৪-৫৫ টাকায়। ইরি-২৯ চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, মিনিকেট ৬৮ থেকে ৭০ আর নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়।
দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, পাইকারি বাজার থেকেই বেশি মূল্যে কিনে আনতে হচ্ছে চাল। মেমো অনুযায়ীই দাম নিচ্ছেন তারা। লোডশেডিংয়ের কারণে মিলপর্যায় থেকে ট্রাক প্রতি চালের ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে মিল থেকে আসা নতুন চাল বস্তা প্রতি দাম বাড়তে পারে ১০০-২০০ টাকা।
সহজ কথা হলো— জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে ট্রাকভাড়া বাড়বে। ফলে চালের দামেও এর প্রভাব পড়বে। কুষ্টিয়া থেকে ২৫০ বস্তার এক গাড়ি চাল আসতে খরচ লাগে ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু আমাকে বলে দেয়া হলো পরিবহন খরচ আরও চার হাজার টাকা বৃদ্ধি পাবে। এখন পরিবহন খরচ বাড়লে চালের দামও বাড়বে, বৃদ্ধি পাবে ধানের দাম। এভাবেই চলতে থাকবে।
এদিকে সবজি বিক্রেতারা বলছেন, সামান্য কিছু সবজির দাম বেড়েছে। কিছু পণ্য আগে কেনা থাকায় সব পণ্যের দাম বাড়েনি। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা ওই বিক্রেতার। কারণ ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে সবজিসহ কৃষিজাত সবপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আর তাই বাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। চার ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে।
এ চার ধরনের জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর। তখন প্রতি লিটারে দাম ৬৫ টাকা থেকে ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা। ৯ মাসের মাথায় তা এক লাফে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকায় করা হলো। অকটেন আর পেট্রোলের দাম সর্বশেষ বাড়ানো হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল।
সেই হিসাবে ছয় বছর দুই মাস পর বাড়ল এ দুই তেলের দাম। ৮৬ টাকার প্রতি লিটার পেট্রোল এখন ৪৪ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আর ৮৯ টাকার অকটেন ৪৬ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৩৫ টাকা।