দীর্ঘদিন ধরেই নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী নিয়ে অস্বস্তিতে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, নজিরবিহীন লোডশেডিং, গণপরিবহনের ভাড়াবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়ে উঠেছে বিষফোঁড়া। যার প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারবিরোধী মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ ও আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেছে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার হটানোর প্রস্তুতির কথা বলছেন তারা।
এমন অবস্থায় দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল পূর্বঘোষিত সমাবেশ ছিল বিএনপির। ঢাকা মহানগরসহ বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশস্থলে সমবেত হন। সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির সমাবেশ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। গত কয়েক বছরের মধ্যে এমন জনসমাবেশ ঘটাতে পারেননি দলটির শীর্ষ নেতারা। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বারবার ব্যর্থ হয়েছে দলটি। বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি না হয়, সে জন্য কঠোর অবস্থানে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সমাবেশকে ঘিরে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ আন্দোলনকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েই দেখছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তারা চায়, তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হোক। ফলে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ে আরও বড় আন্দোলন করতে চায় দলটি।
এদিকে দেশের অভ্যন্তরে চলমান সংকটকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবেই দেখছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তাদের দাবি— মহামারি করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সারা বিশ্ব মন্দার কবলে পড়ায় সরকার নিরুপায় হয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য নিম্নমুখী হলেই, তার সাথে সমন্বয় রেখে দেশেও কমানো হবে বলে দাবি ক্ষমতাসীনদের।
তবে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক সমস্যা দেখলেও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর আন্দোলন এবং সমাবেশকে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। তারা বলছে, আগস্ট মাস এলে বিএনপি উন্মাদ হয়ে যায়। খুনিদের মতো কথা বলে। একাত্তরের খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করতে চায়। কিন্তু বিএনপি যদি হত্যা, খুন ও ধ্বংসের রাজনীতি করে, তাহলে রাজনীতির মাঠেই তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেয়া হবে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল বিএনপির পূর্বঘোষিত সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আগামী ২২ আগস্ট থেকে দেশের প্রতিটি থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছড়িয়ে
পড়তে হবে। প্রথমে উপজেলা, এরপর প্রতিটি ইউনিয়ন-গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ব। পরে জেলা ও মহানগরগুলোতে বিক্ষোভ সমাবেশ করব। জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এ অনির্বাচিত অবৈধ সরকারকে পতনে বাধ্য করব।’
মির্জা ফখরুল তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারকে বলতে চাই, অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। এই মুহূর্তে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নতুন নির্বাচন দিয়ে সংসদ গঠন করতে হবে। সরকার গঠন করতে হবে। দলের নেতাকর্মীদের রাজপথ দখলের আহ্বান জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমাদের রাজপথ দখল করতে হবে। রাজপথ দখলের মধ্য দিয়ে এ সরকারকে বিদায় করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তরুণ সমাজই দেশকে স্বাধীন করেছে। আমরা যখন তরুণ ছিলাম, যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছি। আজ আবারও এ তরুণ সমাজকে জেগে উঠতে হবে। তরুণদের নতুন করে দেশ স্বাধীন করতে হবে। সেই স্বাধীনতা হবে আমাদের গণতন্ত্রের। বিএনপি মহাসচিব বলেন, সংগ্রাম শুরু হয়েছে, লড়াই শুরু হয়েছে। এ লড়াই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই।
এ লড়াই বিএনপির নয়, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বাঁচা মরার লড়াই। আমাদের লড়াইয়ে শরিক হতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমরা ফ্যাসিস্ট, দানবীয়, মাফিয়া সরকারকে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারব।’
আওয়ামী লীগ পালানোর পথ পাবে না— বিএনপি নেতাদের এমন কথার জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনারা প্রতিদিনই সরকারের পতন দেখতে পাচ্ছেন। প্রতিদিনই বলে সরকার পালিয়ে যাবে। কোথায় পালাবো? আওয়ামী লীগের পালানোর ইতিহাস নেই, প্রয়োজনে জেলে যাব। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের জরুরি সভায় তিনি একথা বলেন। আওয়ামী লীগ মাঠে নামলে বিএনপির আন্দোলন কর্পূরের মতো উড়ে যাবে উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দেশ বাংলাদেশ।
পালানোর ইতিহাস আমাদের নেই। প্রয়োজনে দেশের মাটিতে জেলে যাব। আওয়ামী লীগ পলাবার দল নয়। পালাবার দল আপনারা (বিএনপি)। আপনাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কোথায়? জরুরি সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে এখান থেকে পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগকে পালানোর কথা বলছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, সবাই প্রস্তুত আছেন? আছেন মাঠে? খেলা হবে, মোকাবিলা হবে, ফ্রি-স্টাইল বাংলাদেশে হতে দেব না আমরা।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিরোধী কর্মসূচি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এটা তো গণতন্ত্রের বিষয়। আমরা তাদের বাধা দেব কেন? তারা যদি এই আন্দোলনের সঙ্গে সহিংসতার উপাদান যুক্ত করে। আগুন সন্ত্রাস নিয়ে মাঠে নামলে আমরা নীরব হয়ে বসে থাকব? ঘরে বসে থাকব? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কি আঙুল চুষবে? প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। রাজপথে মোকাবিলা হবে।
কাদের বলেন, আজকে বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এই পরিস্থিতি হয়েছে। যখন স্বাভাবিক সময় আসবে তখন আমাদের প্রমিজ থেকে পিছিয়ে যাব না। কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি মূল্য কমলে আমরাও এখানে সমন্বয় করব। এটা বলার পরও আজকে বিএনপিসহ তাদের দোসররা মাঠে নেমেছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করছে, বিষোদগার করছে। জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ে নানান কথা বলছে। আট হাজারেরও বেশি টাকা বাংলাদেশ ভর্তুকি দিয়েছে।
কত ভর্তুকি? তারপরও আমাদের নেত্রী বলে, আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন। আমার তো মনে হয় এই সংকট থেকে তিনি মুক্তি দিতে পারবেন। সেই আত্মবিশ্বাস আমাদের নেত্রীর রয়েছে। তিনি বলেন, আজকের সংকট সাময়িক। এই সংকট কেটে যাবে এবং এই সংকট থেকে জন্য সবকিছুই প্রধানমন্ত্রী করে যাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ রাজপথ থেকে ক্ষমতায় এসেছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, তারা (বিএনপি ও সমমনা দলগুলো) যেভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে, রাজপথ মনে হয় আমরা ভুলে গেছি। আমরাও আছি। অচিরেই রাজপথে দেখতে পাবেন। শোকের মাসে হয়তো আমরা কিছু কিছু প্রোগ্রাম করছি না। আমরা চিন্তা করছি অপপ্রচার, মিথ্যাচার, সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আমাদেরও প্রতিবাদ করতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে। সেই জন্য আমরা আগামী ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা দিবসে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে একটা বিক্ষোভ সমাবেশ করব। আগামী বুধবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চত্বরে সবাই মিলিত হবো। কিছুক্ষণ সমাবেশ করার পর আমরা মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পর্যন্ত আসব। এই কর্মসূচি জেলা-উপজেলা, থানা ও ইউনিয়নে পালন করা হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, আগস্ট মাস এলে বিএনপি উন্মাদ হয়ে যায়। খুনিদের মতো কথা বলে। একাত্তরের খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করতে চায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানের এজেন্ট, দোসররা ক্ষমতার মসনদে বসে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক মেরেছিল। বাংলাদেশকে অন্ধকারে নিপতিত করেছিল। খুনি জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করেছিল। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন।
নাছিম বলেন, সামপ্রদায়িক, দেশবিরোধী শক্তি একাত্তরে পরাজিত হলেও নিঃশেষ হয়নি। তারা এখনো দেশে বিদেশে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি প্রতিদিন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা সামপ্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটিয়ে দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে চায়।
তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার আদর্শের সন্তান। কেউ হত্যা, খুন, ধ্বংসের রাজনীতি করলে আমরা মোকাবিলা করব। খুনিদের বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে প্রতিহত, পরাজিত করে অপরাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেব। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
গতকাল জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বলেন, দেশে উন্নয়নের নামে ঘুষ ও দুর্নীতির জোয়ার বইছে। সংসদে আমরা কথা বললে কাজ হয় না। তিনি আরও বলেন, দেশ পরিচালনায় সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। তেলের দাম না বাড়ালেও পারতো সরকার। ভ্যাট-ট্যাক্স না নিলে এবং জ্বালানি তেলের মুনাফা সমন্বয় করলেই দাম বাড়ানো লাগতো না। যে সরকার তেলের দাম বাড়িয়ে মুনাফা করে কিন্তু মানুষের কষ্ট বোঝে না সেই সরকার জনগণের সরকার নয়। গণবিরোধী সরকার মানুষের কষ্ট বোঝে না। প্রজাতন্ত্রের নামে দেশে এক ব্যক্তির শাসন তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে দেশে স্বৈরশাসন চলছে। উন্নয়নের নামে ঘুষ ও দুর্নীতির জোয়ার বইছে।