মজা করে অনেকে বলেন, ‘গরিব মানুষ দিন আনে দিন খায়, আর ব্যাচেলররা ডিম আনে ডিম খায়’। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে টিকে থাকতে নানাভাবে ব্যয় সংকোচন করেন রাজধানীসহ সারা দেশের কয়েক কোটি ব্যাচেলর। পরিবারের চাহিদা জোগান দিতে অথবা অর্থ সংকটে স্বল্প খরচে কয়েকজন মিলে রুম শেয়ার করে যারা বসবাস করেন তাদেরকেই ব্যাচেলর বলা হয়।
আবার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও একইভাবে বসবাস করেন। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাচেলররা ইচ্ছা থাকলেও সবসময় মাছ-গোশত খেতে পারেন না। তাই অধিকাংশ সময় ডিম ও ব্রয়লার মুরগিতেই তাদের ভরসা করতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সব পণ্যের মতো এ দুটি জিনিসের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তাই টিকে থাকতে ডিমের বিকল্প খুঁজছেন ব্যাচেলররা।
রাজধানীর কমলাপুরে একটি বাসায় রুম শেয়ার করে থাকেন মো. ফয়সাল আহমেদ। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মাসে যে টাকা আয় করেন তার বেশিরভাগ পরিবারের খরচ মেটাতে গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হয়। তাই রুম শেয়ার করে থাকা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।
আমার সংবাদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘খরচ কমাতে মাসের বেশিরভাগ দিনই ডিম খেতে হয়। মাঝেমধ্যে ব্রয়লার মুরগি ও পাঙ্গাস মাছ থাকে খাদ্যতালিকায়। কিন্তু গত কয়েকদিন সব জিনিসের মতো পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডিম ও মুরগির দাম। দেড়শ টাকার ব্রয়লার মুরগির কেজি এখন ২০০ টাকার বেশি। আর ডিমের হালি এখন ৫০ টাকা। তাই এখন বিকল্প কি খাব তা নিয়ে রুমমেটদের মধ্যে আলোচনা চলছে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য থাকছে না। তিন বেলা খাবার জোগাড় করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বাধীন দেশে খাদ্য নিরাপত্তা আমার মৌলিক অধিকার। সংবিধান যে অধিকার আমাকে দিয়েছে তা থেকে আমি বঞ্চিত হচ্ছি। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। আমরা এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।’
অন্যদিকে যাতায়াতসহ সব খাতে খরচ বৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তের জীবন থমকে দাঁড়িয়েছে। গরিবের সংসারে চলছে হাহাকার। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকার মতিঝিলে এসে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী পদে চাকরি করেন আসাদ শেখ। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বাসভাড়া ২০ টাকা বেড়ে ৪০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে।
অর্থাৎ আসা-যাওয়ায় তার ব্যয় বেড়েছে ৪০ টাকা। মাসে যাতায়াতে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ১২০০ টাকা। এ ছাড়া দুই সন্তানের স্কুলে যাতায়াতে রিকশা ও বাসভাড়া মিলে অতিরিক্ত আরও ১৫০০ টাকা যোগ হয়েছে। অর্থাৎ শুধু যাতায়াতেই তার খরচ বেড়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা।
অন্যদিকে সবজি, মাছসহ অন্যান্য খাদ্যপণের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বাসাভাড়া ও অন্যান্য ব্যয়সহ মাসিক খরচের খাতায় সাত থেকে আট হাজার টাকা অতিরিক্ত যোগ হয়েছে।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মাসে বেতন ২৫ হাজার টাকা। এই বেতন নিয়ে এমনিতেই সংসারে টানাটানি অবস্থা। তার মধ্যে হঠাৎ যদি সাত-আট হাজার টাকা ব্যয় বাড়ে, তাহলে জীবন ধারণ করাই কঠিন হবে। আর আমাদের মতো সরকারি চাকরিজীবীদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষ বাঁচবে কিভাবে?’
সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। স্কুল, বাজার, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, বাস, নৌযান অর্থাৎ জ্বালানি তেলনির্ভর
সব যানবাহনে বেড়েছে ভাড়া। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে অন্যান্য নিত্যপণ্যে।
ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা আর অকটেন-পেট্রলের দাম ৪৪ ও ৪৬ টাকা করে বাড়ানোর পর দেশে বাসভাড়া বেড়েছে নগর পরিবহনে কিলোমিটারপ্রতি ৩৫ পয়সা, দূরপাল্লায় ৪০ পয়সা। কিন্তু ভাড়া আসলে যতটা হওয়ার কথা, আদায় চলছে তার চেয়ে বেশি।
আবার ট্রাক ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি দর। আবার কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় এক টাকা বাড়লেও ছোট নোটের অভাবে আদায় হচ্ছে পাঁচ থেকে ১০ টাকা। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
কেউ শখ আহ্লাদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছেন, কেউ সন্তানদের পড়ালেখা ও খেলনা ও প্রসাধনীতে ব্যয় কমাচ্ছেন, কেউ ঘোরাঘুরি বাদ দিচ্ছেন, কেউ আড্ডায় কম যাচ্ছেন, আবার কেউবা কম খাচ্ছেন।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ত্বরিতগতিতে নেয়া জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত ও অগণতান্ত্রিক। এতে মানুষের খাদ্য, শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলো মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়েছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এমনিতেই আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা সুযোগ সন্ধানী। তারা অতিমুনাফার জন্য নৈতিক দিক থেকে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এবার জ্বালানি তেলের দাম এত বেশি বাড়ানো হয়েছে যে, তাতে এমনিতেই খরচ অনেক বাড়বে। তার ওপর ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে। যা বেড়েছে তার চেয়ে বেশি নিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ অনেকটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। মানুষ তো কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাদের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলা করতে পারিপার্শ্বিক অনেক ব্যয় কাটছাঁট করতে হবে।’