জালজালিয়াতি আর অব্যবস্থাপনায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। মূল্যস্ফীতির চাপে ভাটা পড়েছে আমানত সংগ্রহে। তীব্র ডলার সংকটে টান পড়েছে নগদ টাকায়। আদালতের দ্বারস্থ হয়েও আদায় করা যাচ্ছে না টাকা। তাই আদায়ের চেয়ে তথ্য আড়াল করছে তৎপর ব্যাংকগুলো। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতিও (প্রভিশন) রাখতে ব্যর্থ অনেক ব্যাংক।
এত সব সংকটেও বাহ্যিক চেহারা ভালো দেখাতে হিসাবের খাতা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে (অবলোপন) বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ। ঢালাও সুবিধা দিয়ে ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ঋণ শ্রেণিকরণের দায়িত্ব। ফলে কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমলেও বড় আর্থিক চাপের পাশাপাশি খেলাপিরা আবারো হাতিয়ে নেবে মোটা অঙ্কের অর্থ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সুযোগে নতুন নতুন ঋণ সৃষ্টির ফলে সার্বিকভাবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। তবে এসএমই খাতসহ উৎপাদনমুখী খাতে ঋণ প্রবাহ ব্যাহত হবে। এতে একদিকে যেমন আরও চাপের সম্মুখীন হবে ব্যাংকগুলো, অপরদিকে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে।
আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে খেলাপি : চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। তিন মাস আগে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। তার আগের তিন মাসে বেড়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
আদায় হচ্ছে না অপলোপনকৃত ঋণ : ব্যাংকের মন্দমানের খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্সশিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজারে সংরক্ষণ করা হয়। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ নামে পরিচিত। বিভিন্ন ছাড় দিয়েও যখন খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না, তখন বিদ্যমান পুরনো কৌশলেই তা কমানোর চেষ্টা করছে ব্যাংকগুলো। আর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ কৌশলটির নাম ঋণ অবলোপন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ অবলোপন হয়েছে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকা। সব মিলে গত মার্চ শেষে ব্যাংকি খাতে খেলাপি ঋণ অবলোপনের পুঞ্জীভূত স্থিতি ছিল ৫৯ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। এ ঋণ থেকে গত ১৯ বছরে আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। ফলে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নিট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। অবলোপনের কারণে এ পরিমাণ ঋণ আর ব্যাংকের মূল হিসাবে দেখাতে হচ্ছে না। এটি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ এখন এক লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে জুন পর্যন্ত অবলোপনের হিসাব যোগ হলে এ পরিমাণ আরও বাড়বে।
নিয়ম অনুযায়ী, সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ দেয় তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রাখা হয়েছে। ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
তবে খেলাপি ঋণ বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ৯টি ব্যাংক। এ তালিকায় চারটি সরকারি ও বেসরকারি পাঁচটি ব্যাংক রয়েছে। চলতি জুন শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৮ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। ঘাটতির তালিকায় রয়েছে সরকারি অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী। বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, সাউথইস্ট ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের নাম। তবে কিছু কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি ১৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা।
নগদ টাকার সংকট : ক্রমেই বাড়ছে নগদ টাকার সংকট। ফলে সরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ঋণ নিচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরে ২ আগস্ট পর্যন্ত এক মাস দুই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে আট হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমেছে দুই হাজার ৪০১ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মোট ১১টি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ছয়টি নিলামেই প্রাইমারি ডিলাররা ঋণ দিতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিয়েছে। এক বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি সুদ পাওয়ার পরও অনেক ব্যাংকের এখন সরকারকে ঋণ দেয়ার মতো সক্ষমতা নেই। বরং সংকট মেটাতে অন্য ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করছে।
আমানত কমছে বাড়ছে ঋণ : ব্যাংকগুলোতে আমানতের চেয়ে ঋণ বেড়েছে বেশি হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় গেলো অর্থবছরে আমানত বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৪ দশমি ৩৬ শতাংশ বেশি। ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে কতটুকু পরিমাণ ঋণ দিতে পারবে তা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদ্যমান নিয়মে ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক ৮৭ টাকা ঋণ দিতে পারে। ইসলামী ধারার ব্যাংক দিতে পারে ৯২ টাকা। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের ঋণ-আমানত অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৮০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের ৭৬ দশমিক ৫৫ এবং বিদেশি ব্যাংকের ৫৫ শতাংশ।
তীব্র ডলার সংকট : সমপ্রতি সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এক কোটি ৫৫ লাখ ডলারের আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খোলার চাহিদা এসেছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানার রূপালী ব্যাংকে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড়শ কোটি টাকা সমমূল্যের এলসিটি ফেরত দিয়েছে ব্যাংকটি। আরেক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক দেশের বাইরে বিভিন্ন অঙ্কের ৩৩টি বিল পরিশোধের বিপরীতে ১০৫ কোটি টাকা পাঠানোয় অপারগতা জানিয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও বিনিময়হারজনিত লোকসানের কথা বলা হয়েছে। এভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক এলসি ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। বেসরকারি খাতের এলসি না খোলার ঘটনাও রয়েছে প্রচুর।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংক যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতির জন্য বড় নিয়ামক হলেও যারা খেলাপি হচ্ছে বারবার তাদেরই মোটা অঙ্কের ঋণ দেয়া হচ্ছে। এসব ঋণ বিতরণে নেয়া হচ্ছে জালজালিয়াতির আশ্রয়। জামানত ছাড়াই ঋণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভুয়া জামানাতের বিপরীতে ঋণ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নদীগর্ভে বিলীন এমন জমি, কবরস্থান, সরকারি জমি, মহাসড়ক ইত্যাদি জামানত রেখে বিপুল অঙ্কের ঋণ হাতিয়ে নিচ্ছে ক্ষমতাশালীরা। এসব ক্ষেত্রে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
গত রোববার এক সেমিনারে ব্যাংকগুলোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, নগরাঞ্চলে বড় গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে শহর-গ্রামের মধ্যে বৈষম্য বাড়ানো ব্যাংকের কাজ নয়। বরং উন্নয়ন সুষম করার দায়িত্ব। সে জন্যই তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআই সভাপতি ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, খেলাপি সত্ত্বেও বড় শিল্পপতিদের চাইলেই ঋণ দেয়া হচ্ছে। অথচ নানা শর্তের বেড়াজালে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো বড় পার্টি ফোন দিলেই ঋণ হয়ে যায়। কোনো নিয়ম-কানুন নেই। তারা পার্সোনাল গ্যারান্টিও দিতে চায় না।’