নিয়ন্ত্রণ নেই অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের। অভিযান শুরু হয়, হাসপাতাল বন্ধ হয়। অভিযান ঝিমিয়ে গেলে চক্র সক্রিয় হয়। প্রায় গণমাধ্যমের খবর আসে ভুয়া সার্জনের অপারেশনে প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ। আবার রোগীর জটিল পরিস্থিতি হলেও চিকিৎসক পালিয়ে যাওয়ার খবর আসে। পরে জানা যায়, চিকিৎসকের মতো প্রতিষ্ঠানটিও অবৈধ। দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু যেন স্বাভাবিক বিষয়। আর উচ্চহারে বিল আদায়ের ঘটনা তো রয়েছেই। সাধারণ মানুষ এই চক্রের কাছে জিম্মি।
সম্প্রতি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে এসপিএ ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং কর্তব্যরত চিকিৎসক বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অনুমোদনহীন ডিগ্রি ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ আসে। ওই ঘটনার অনুসন্ধানে নেমে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান মেসবাহ ও তার টিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন।
হাসপাতালের মালিক ডা. এম এইচ উসমানীর নেতৃত্বে ওই হাসপাতালে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। ভাঙচুর করা হয় ক্যামেরা ও গাড়ি। পরে ভুক্তভোগী সাংবাদিক থানায় মামলা করলে আটক করা হয় ডা. এম এইচ উসমানীকে। সাময়িকভাবে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত মঙ্গলবার ডা. এম এইচ উসমানীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত কারাগারে পাঠায়।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, গত মে মাসের শেষের দিকে টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরপর মা ও নবজাতক মৃত্যুর ঘটনায় কর্তাদের টনক নড়ে। তিন দিনের মধ্যে দেশের সব অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই সময়ের পর নিবন্ধনহীন কোনো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ঘোষণাও তখন দেয়া হয়। এতে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরও চালু ছিল কামরাঙ্গীর চরের এসপিএ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের মালিক ডা. এম এইচ উসমানীর বন্ধু একজন চিকিৎসক নেতা ও একটি প্রথম সারির মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। তার আশীর্বাদে উসমানীর হাসপাতালটি অভিযানের মধ্যেও ছিল বহাল তবিয়তে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মে মাসের পর অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের গতি অনেকটা কমে গেছে। এই সুযোগে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠেছেন অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকরা। বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠান ভিন্ন নামে কিংবা একই নামে ফের চালু করে অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিকের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযান একটি চলমান প্রক্রিয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. বেলাল হোসেন বলেন, ‘অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি চলমান প্রক্রিয়া। অধিদপ্তরের প্রতিটি সাপ্তাহিক বৈঠকে হাসপাতালের প্রধান, সিভিল সার্জন ও ইউএচএফপিওদের অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিষয়ে মনিটরিং বাড়াতে জোর দেয়া হয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে নিবন্ধনভুক্ত বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে ১১ হাজার ৮১টি। তার মধ্যে তিন হাজার ৭৬৩টি হাসপাতাল, সাত হাজার ১৫৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক ১৬২টি। গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত এক হাজার ৬৪১টি অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। নতুন করে অনুমোদন দেয়া হয়েছে এক হাজার ১৩০টি এবং প্রায় দুই হাজার ১০০টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক বলেন, ‘গত ২৬ মের পর অভিযানে যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল তাদের অনেকে অনুমোদন পেয়েছে। এরপরও যদি কেউ অভিযানে বন্ধ করে দেয়া প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে চালু করে থাকে— তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আগামী সপ্তাহের মিটিংয়ে জোর দেয়া হবে। দুর্ঘটনার পরেই কেন জানা যায় যে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন নেই। কিংবা চিকিৎসক ভুয়া।
আগে কেন জানা যায় না— এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক সামিউল ইসলাম বলেন, লোকবল কম থাকায় অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযানের পর সবসময় শতভাগ মনিটরিংয়ের সুযোগ হয় না। আর এই সুযোগে কিছু অসাধু হয়তো ভিন্ন নামে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে আমাদের অভিযান ও কঠোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’
নিবন্ধনহীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা চাই না স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলুক। ভুয়া চিকিৎসক, নার্স দিয়ে কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান চালানো যাবে না। সেই সাথে ভুয়া, অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানও চালু রাখা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘প্রশাসনকে আমরা এ বিষয়ে তাগিদ দিয়েছি। আগামীতে এ বিষয়ে আমাদের মনিটরিং আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার। এ জন্য চারটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে।’