নতুন সদস্যের আগমন ঘিরে সব পরিবারে থাকে নানা আনন্দ পরিকল্পনা। কিন্তু প্রসূতি নারী কিংবা নবজাতকের মৃত্যু গোটা পরিবারকে বিষাদে ঘিরে ধরে। যদিও সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদানে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু প্রান্তিকে প্রাইভেট ক্লিনিকের অবহেলা, ভুয়া চিকিৎসক আর অব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর সংবাদ আসছে।
গত ২১ আগস্ট গাজীপুরের কালীগঞ্জের তুমলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চুয়ারিয়াখোলা গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের প্রসূতি স্ত্রী শিরিন বেগমকে (৩২) উপজেলার জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভর্তি করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, শিরিন রক্তশূন্যতায় ভুগছে। পরে এ-পজিটিভ রক্তের পরিবর্তে বি-পজিটিভ রক্ত পুশ করা হয়।
পরে অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। পথিমধ্যে শিরিনের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলে রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসক গা ঢাকা দিয়েছেন। বন্ধ রয়েছে তাদের ব্যবহূত মুঠোফোনও।
নিহতের ননদ হোসনে আরা বলেন, রোববার সকালে আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী হঠাৎ ব্যথা অনুভব করেন। এ সময় একই এলাকার বাসিন্দা জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক বন্যা বেগমের কাছে যাই পরামর্শের জন্য। বন্যা তার হাসপাতাল থেকে দুজন নার্স পাঠান রোগী নিয়ে যাওয়ার জন্য।
পরে সেখানে রোগী নিয়ে গেলে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিজার করেন ওই হাসপাতালের ডাক্তার মাসুদ। এ সময় প্রসূতি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় নিয়ে অপারেশন করার পর ডাক্তার জানান রোগীর জরায়ু ফেটে গেছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে, বি-পজিটিভ রক্ত লাগবে। তাদের কথামতো বি-পজিটিভ রক্ত জোগাড় করে রোগীকে দুই ব্যাগ রক্ত পুশ করা হয়। কিন্তু তাতেও রোগী সুস্থ হচ্ছিল না। শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছিল।
পরে যখন পুনরায় রোগীর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হয়, তখন জানা যায় রোগীর রক্তের গ্রুপ এ-পজিটিভ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখে রাত ৮টার দিকে রোগীর অবস্থা খারাপ বলে তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেয়। পরে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় রওনা দিই। এসময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুই ব্যাগ এ-পজিটিভ রক্তের ব্যাগ রোগীর সাথে দিয়ে দেয়।
ঢাকায় নেয়ার পথে রোগীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, রোগীকে মৃত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অভিযোগ আছে, এর আগেও এই হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় একাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রাজশাহীর তানোর মহানগর ক্লিনিকের গর্ভবতী নারীদের সিজারিয়ান অপারেশন করছেন ক্লিনিকের ম্যানেজার মামুনুর রশীদ। তার বাড়ি পৌর এলাকার আমশো গ্রামে।
অভিযোগ রয়েছে, ক্লিনিকটিতে ডাক্তার তো দূরের কথা একজন ভালো মানের নার্স পর্যন্ত নেই। মালিকের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে মামুন ভুয়া ডাক্তার সেজে চিকিৎসার নামে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা জালিয়াতি করে আসছেন। মামুনের অপারেশনে অনেক প্রসূতি-নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামেও রয়েছে অবহেলার অভিযোগ। দিনাজপুরের খানসামা ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে নার্সের অবহেলায় গত ১৯ আগস্ট এক নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ওই কেন্দ্রের অভিযুক্ত সহকারী নার্স আফরোজা আক্তারকে বদলি করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ১৯ আগস্ট বিকেলে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের আমতলী এলাকার ফয়েজ উদ্দিনের স্ত্রী ফতেজা বেগমের (৩৭) প্রসব ব্যথা শুরু হয়।
এসময় তাকে খানসামা ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। রাত ১০টায় ব্যথা আরও বেড়ে যায়। তখন রোগীর পরিবারের লোকজন কর্তব্যরত সহকারী নার্স আফরোজার কাছে জানান তারা অন্য হাসপাতালে নিতে চান। কিন্তু নার্স রেফার্ড না দিয়ে বলেন, সমস্যা নেই, এখানেই ডেলিভারি করা যাবে। এরপর প্রসূতিকে একটি ইনজেকশন পুশ করা হয়। মধ্যরাতে ভূমিষ্ঠ হয় নবজাতক। কিছুক্ষণ পর ওই নবজাতককে মৃত ঘোষণা করে কর্তব্যরত নার্স।
উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হাসানুর রহমান চৌধুরী বলেন, প্রসবের আগেই শিশুটি মারা যায়। এরপরও অভিযোগের ভিত্তিতে সহকারী নার্স আফরোজা আক্তারকে বদলি করা হয়েছে। এ হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ থাকলেও কাউকে পদায়ন দেয়া হয়নি। এখন থেকে প্রসূতির প্রসব সেবা বন্ধ থাকবে। শুধু চেকআপ করা হবে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, সরকারি কিংবা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অবহেলায় মৃত্যু স্বাস্থ্য বিভাগের চরম অযোগ্যতা। চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার ফল। হাসপাতাল ক্লিনিকে মানুষ সুস্থতার আশা ভরসা নিয়ে আসে কিন্তু সেখানে অবহেলায় হয় মৃত্যু। এসব যেন দেখার কেউ নেই। গা শিউরে ওঠার মতো কথা— হাসপাতালের ম্যানেজার অপারেশন করছেন। ভুল গ্রুপের রক্ত প্রয়োগে প্রসূতি নারী মৃত্যুর অভিযোগ।
নার্সের অবহেলায় সরকারি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। এসব তো সাঙ্ঘাতিক খবর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন তো এইসব অব্যবস্থাপনার বিষয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সেই রকম তৎপরতা তো দেখছি না। আমার মনে হচ্ছে মানুষের জীবনের দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে পড়ছে।
তিনি বলেন, মাঝখানে কিছু অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ হলো এখন আবার ঝিমিয়ে পড়ছে। ফলে চাঙ্গা হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। দেশের এত বড় সেক্টর বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর ক্লিনিক যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার অল্প লোকবল দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। এ জন্য আলাদা একটি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সারা দেশে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা ও তদারকির জন্য প্রচুর লোকবল দরকার।
সেই সাথে যুযোপযোগী আইন লাগবে। যাতে কেউ স্বাস্থ্যসেবার নামে অপকর্ম করে দ্রুত জেল থেকে বের হতে না পারে। আরেকটি বিষয়েও জোর দিতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা যেন সহজে এসব ব্যবসায় জড়িয়ে পড়তে না পারেন। এরা এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে রোগীদের সরকারি সেবা পাওয়া দুরূহ হয়ে যায়।