সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষক পর্যায়ে সার সংকট চলছে। বিশেষ করে কুষ্টিয়াসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নন-ইউরিয়া এমওপি সার (মিউরেট অব পটাশ), ডিএপি, ইউরিয়া সার কৃষকদের দিতে পারছেন না স্থানীয় ডিলাররা। যার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে বাড়তি দামে সার বিক্রি করছেন সার দোকানি।
পাঁচ মাস আগে টাকা জমা দিলেও সময়মতো সার না পাওয়া সরকারি ডিলাররা বিপাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সার সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে বলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আগামী কিছু দিনের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে বলে দাবি তাদের। এ ছাড়া সারের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার মধ্যেই অনেক উপজেলায় সাব-ডিলার নিয়োগ দেয়ার খবরে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন ডিলাররা।
চুয়াডাঙ্গা জেলার ভুক্তভোগী এক ডিলার জানান, গত এপ্রিল মাসে নন-ইউরিয়া এমওপি সারের চাহিদা দিয়ে টাকা দিয়েছি। শত চেষ্টা করেও পাঁচ মাসেও সার পাইনি। সারা দিন কৃষকরা সারের জন্য ভিড় জমাচ্ছেন। যশোর বাফা, কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক সার গুদাম, কালিগঞ্জ বাফা থেকে কুষ্টিয়াসহ মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় সার সরবরাহ করা হয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলার আরও একাধিক ডিলার আরও জানান, জুন ও জুলাই মাসের এমওপি সার এখনো অনেক ডিলার পাননি। বিএডিসি থেকে বরাদ্দ হলেও গুদাম থেকে সার দেয়া হচ্ছে না। তাদের অভিযোগ, যেখানে আমরা সার পাচ্ছি না, কৃষকরা ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে সাব-ডিলার নিয়োগ অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
কুষ্টিয়ার স্থানীয় সূত্র মতে, নন-ইউরিয়া এমওপি সারের সংকট চলছে গোটা অঞ্চলে। ডিলারদের দোকানে সার পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলের কিছু দোকানে সার মিললেও ৬৫০ টাকার প্রতি বস্তা এমওপি সার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩০০ টাকা। সব ধরনের সার প্রতি কেজিতে ১৫টাকা পর্যন্ত বাড়তি নেয়া হচ্ছে।
বিএডিসি যশোর সূত্র মতে, সার পরিবহন ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু দিন ধরে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সমন্বয় করা যাচ্ছে না। সার পরিবহন ঠিকাদারের একটি চক্র বাড়তি দাম নেয়ার পাঁয়তারা করছেন।
যশোর বাফার গুদামের তত্ত্বাবধায়ক আকতার হোসেন বলেন, এখন ইউরিয়া সারের কোনো সংকট নেই। ডিএপি সারের মজুত কম থাকলেও দ্রুত স্বাভাবিক হবে। এপ্রিল, মে, জুলাই আগস্ট মাসের কিছু ডিএপি সরবরাহ বাকি আছে।
তিনি বলেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যবসায়ীদের লস হচ্ছিল। এটি অবস্য বিসিআইসি সমন্বয় করে নতুন রেট নির্ধারণ করছে। এখন সরবরাহ স্বাভাবিক হবে আশা করছি।
ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ বাফার ইনচার্জ মুকুল উদ্দিন জানান, বর্তমানে সারের কোনো সংকট নেই। আজও ৫০০ টন সার সরবরাহ করা হয়েছে। এ মাসের বাকি ৩০০ টন আগামীকালের মধ্যে ডিলারদের দেয়া হবে।
চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সার সংকটের কারণে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ডিলারদের কাছে সার পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা দোকানে পাওয়া গেলেও দাম বেশি নেয়া হচ্ছে কেজিতে অন্তত ১০ টাকা। অথচ জেলা-উপজেলা অফিস ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়ার্ডভিত্তিক সাব-ডিলার দেয়ার জন্য কাজ করছেন। যেখানে পুরোনো ডিলাররা সার পাচ্ছেন না, সেখানে সাব-ডিলার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান দাবি করেন, ডিলার পর্যায়ে সার সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে, কৃষকরা সার পাচ্ছেন। সাব-ডিলার নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা বেগম বলেন, সার সরবরাহ কিছু দিন কম ছিল। এ সুযোগে খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি দাম নেয়ার চেষ্টা করেছেন। খুচরা ব্যবসায়ীদেরও যাতে মনিটরিংয়ে আনা যায়, সে জন্য সাব-ডিলার করার চিন্তা আছে। এটি এখনো কোনো প্রক্রিয়া আনা হয়নি। গত সভায় আলোচনা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার বিএডিসির উপ-পরিচালক বিভাস বলেন, আমাদের জেলার এই মুহূর্তে সারের কোনো সংকট নেই। পরিবহন ব্যবস্থার জন্য একটু সমস্যা ছিল, সেটি এখন নেই।
কুষ্টিয়া বিএডিসির (সার) সহকারী পরিচালক মহিউদ্দিন বলেন, পরিবহনের কারণে গুদামে সঠিক সময়ে এমওপি সার আসছে না। তাই ডিলারদের মধ্যে সময়মতো সার সরবরাহ করতে সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে, সারা দেশে সার পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। গতকাল রোববার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ কক্ষটির কাজ চলবে বলে মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষটি সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
এতে বলা হয়, সার-বিষয়ক যেকোনো প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করা হলো। ফোন নম্বর ব্যস্ত থাকলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়ার অনুরোধ করা হলো। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নাম ও ফোন নম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান শেখ বদিউল আলমকে-০১৭১৩৫৯৩৪৮৭ নম্বরে পাওয়া যাবে।
গবেষণা কর্মকর্তা মো. নূরুন্নবীকে পাওয়া যাবে-০১৭১৬৪৬২২৭৭ নম্বরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সার) আমিনুল ইসলামকে-০১৭২৪২৪৫৩৫৪ ও অতিরিক্ত উপপরিচালক খন্দকার রাশেদ ইফতেখার-০১৮১৪ ৯৪৭০৫৪ নম্বরে পাওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। বর্তমানে ইউরিয়া সারের মজুত ছয় লাখ ৫৬ হাজার টন, টিএসপি তিন লাখ ৯৪ হাজার টন, ডিএপি আট লাখ ২৩ হাজার টন, এমওপি দুই লাখ ৭৩ হাজার টন। সারের বর্তমান মজুতের বিপরীতে আমন মৌসুমে (আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত) ইউরিয়া ছয় লাখ ১৯ হাজার টন, টিএসপি এক লাখ ১৯ হাজার টন, ডিএপি দুই লাখ ২৫ হাজার টন, এমওপি এক লাখ ৩৭ হাজার টন চাহিদা রয়েছে।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায়ও সারের বর্তমান মজুত বেশি। বিগত বছরের এই সময়ে ইউরিয়া সারের মজুত ছিল পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার টন, টিএসপি দুই লাখ ২৭ হাজার টন, ডিএপি পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার টন ও এমওপি এক লাখ ৯৬ হাজার টন।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ইউরিয়া সার বিক্রি হয়েছে তিন লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৯ টন, যা বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩২ হাজার ৬০০ টন বেশি। বিগত বছর এই সময়ে ইউরিয়া সার বিক্রি হয়েছিল তিন লাখ ৬৫ হাজার ১৭৯ টন।