ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে দেশে দেশে দেখা দিয়েছে তীব্র জ্বালানি সংকট। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় বেকায়দায় সরকার। এদিকে আমদানি না করে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে ডিজেল সাশ্রয়ী নীতিতে গেলেও ফল পাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ডিজেল রিজার্ভের দিকে ঝুঁকছে সরকার।
এরফলে সরকারি সিদ্ধান্তে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে পুরোদেশ। যার ফলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বাসা, অফিস, হাসপাতাল ও মার্কেটগুলোতে জেনারেটর চলছে হরদম। বিদ্যুৎ চলে গেলে ডিজেলচালিত এসব জেনারেটর চালু করা হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি। সেই সঙ্গে বেড়েছে খরচের পরিমাণও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের চেয়ে জেনারেটরে প্রায় তিনগুণ বেশি খরচ গুনতে হচ্ছে।রাজধানীর একটি ভবনের হিসাব ধরা যাক। ১০ তলাবিশিষ্ট একটি ভবনে ফ্ল্যাট আছে ২০টি। পুরো ভবনে মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
দৈনিক হিসাবে খরচ দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার টাকা। আর ঘণ্টার হিসাবে প্রায় ৮০ টাকা হয়। চলমান লোডশেডিংয়ের কারণে পুরো ভবনের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নিজস্ব জেনারেটর কেনা হলো। পুরো ভবনের জন্য এক ঘণ্টা জেনারেটর চালানো হলে তিন লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়।
এতে বিদ্যুতের চেয়ে তিনগুণ বেশি অর্থাৎ ২৪০ টাকা ব্যয় হচ্ছে। জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমানো এবং বিশ্ব বাজারের বর্ধিত মূল্যের ডিজেল সাশ্রয়ের জন্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং দিলেও বাস্তবে সারা দেশে ডিজেলের বিক্রির হার বেড়েছে কয়েকগুণ।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সারা দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণার পর থেকে রাজধানীর প্রতিটি পেট্রোলপাম্প থেকে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার লিটার ডিজেল বেশি বিক্রি হচ্ছে। আর এসব বিকিকিনি হচ্ছে খোলা বোতল বা ড্রামে করে। যা অফিস ও বাসা বাড়ি কিংবা মার্কেটের জেনারেটর চালানোর প্রয়োজনে নেয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ধনীরা লোডশেডিংমুক্ত হলেও ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ জনগণ। এই লোডশেডিংয়ের কারণে বেড়ে গেছে জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ফসলের মাঠে ইঞ্জিন চালিত কৃষি পাম্পের ব্যবহার। এ কারণে হঠাৎ করেই দেশে বেড়ে গেছে ডিজেল বিক্রি।
অর্থাৎ জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমানো এবং ডিজেল সাশ্রয়ের জন্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং দিলেও সেই লোডশেডিংয়ের ফলেই খরচ হয় টনকে টন ডিজেল। বিপিসি তথ্যমতে, ১৭ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে দেশে ডিজেল (এইচএসডি) বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ২০ হাজার ৮১৪ মে. টন, ১৬ হাজার ৩৭১ মে. টন, ১৫ হাজার ৭২১ মে. টন, ১৪ হাজার ৯৭৯ মে. টন এবং ২৫ হাজার ১৬৮ মে. টন।
আর লোডশেডিং শুরুর পর ২৪ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ১৯ হাজার ৩০৭ মে. টন, ১৫ হাজার ৩০৮ মে. টন, ১৭ হাজার ৪৩৭ মে. টন, ১৬ হাজার ৩৫৩ মে. টন এবং ২৮ হাজার ৯৪১ মে. টন। অর্থাৎ লোডশেডিংয়ের আগের চেয়ে পরে ডিজেলের বিক্রি বেশি হয়েছে।
বিপিসির তথ্যমতে, আগস্টের ৬ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দেশে ডিজেলের মজুত ছিল যথাক্রমে চার লাখ ২৩ হাজার ৮৩৭ মে. টন, চার লাখ ৯ হাজার ৬০২ মে. টন, চার লাখ এক হাজার ২৮ মে. টন এবং তিন লাখ ৯৪ হাজার ৩৮৯ মে. টন। সর্বশেষ ১৯ আগস্ট ডিজেলের মজুত ছিল চার লাখ ৮৭ হাজার ৪২২ মে. টন এবং ২০ আগস্ট ছিল চার লাখ ৭২ হাজার ৪১৫ মে. টন।
অর্থাৎ ১৯ তারিখে ডিজেল বিক্রি হয়েছে ১৫ হাজার সাত মে. টন। বিপিসি বলছে, একইভাবে (১৭-২১ জুলাই) অকটেন (এইচওবিসি) বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে দুই হাজার ৬৬৩ মে. টন, এক হাজার ৫১৪ মে. টন, এক হাজার ৫৬০ মে. টন, এক হাজার ৭৪৬ মে. টন, দুই হাজার ৪৯৭ মে. টন। আর লোডশেডিং শুরুর পর অকটেনের ব্যবহার হ্রাস পেয়ে ২৪ থেকে ২৮ জুলাই বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৮৭৪ মে. টন, এক হাজার ৫৫৯ মে. টন, এক হাজার ৪৮০ মে. টন, এক হাজার ৫৩৫ মে. টন এবং দুই হাজার ৬৬৬ মে. টন।
একইভাবে পেট্রোল (এমএস) বিক্রি কমে গেছে। বিপিসির তথ্যমতে, ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনের হিসাবে পেট্রোল (এমএস) বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে দুই হাজার ৮৭৩ মে. টন, এক হাজার ৯৪৩ মে. টন, এক হাজার ৬৭০ মে. টন, এক হাজার ৫০৯ মে. টন, দুই হাজার ১৭৪ মে. টন। অথচ পরের পাঁচ দিন (২৪ থেকে ২৮ জুলাই) বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ১৪০ মে. টন, এক হাজার ৬২৭ মে. টন, ১৭৫৮ মে. টন, ১৪০৭ মে. টন এবং ২১৫৫ মে. টন।
পেট্রোল পাম্প মালিকরা বলছেন, আগের থেকে ডিজেল বিক্রি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার লিটার ডিজেল খোলা বোতলে বিক্রি হচ্ছে। এ তেল বিভিন্ন অফিস বা বাসা-বাড়ি কিংবা হাসপাতালের জেনারেটরে ব্যবহার করা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে কমেছে অকটেন বিক্রি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের জ্বালানি সাশ্রয়ের নীতির গল্প হলো ‘কৃপণের ধন কুমিরে খায়’ অবস্থা। আমরা ঠিকই লোডশেডিংয়ে পুড়ে ডিজেল সাশ্রয় করছি। কিন্তু জেনারেটর আর সেচ পাম্প গিলে খাচ্ছে সাশ্রিত ডিজেল।
এক মার্কেট মালিকের দেয়া তথ্য মতে, এক ঘণ্টায় ডিজেলে ১২০০ টাকা খরচ হয়। এই সময়ে পুরো মার্কেটে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২৫০ টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়। এক ঘণ্টা জেনারেটর চালু থাকলে বিদ্যুতের চেয়ে জার-পাঁচগুণ বেশি খরচ হয়।
মগবাজারের একটি শপিংমলে রয়েছে ৫০০ কিলোওয়াটের জেনারেটর। বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয় সেটি। ৫০০ কিলোওয়াটের জেনারেটরে জ্বালানি হিসেবে প্রতি এক ঘণ্টায় কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়। প্রায় ছয় হাজার টাকার জ্বালানি লাগে। যা পুরো মার্কেটের দু-তিনদিনের বিদ্যুৎ বিলের সমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ছোট বড় শপিংমল ও মার্কেটগুলোতে রয়েছে শক্তিশালী জেনারেটর। এছাড়া হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনগুলোতে রয়েছে মধ্যমসারির জেনারেটর। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন কিংবা সরবরাহ বন্ধ থাকলে এসব জেনারেটর চালু করা হয়। এ জন্য জ্বালানি হিসেবে প্রয়োজন হয় ডিজেল। মার্কেট ও শপিংমলের জেনারেটগুলো বড় হওয়ায় জ্বালানি তেল বেশি লাগে। কোনো কোনো জেনারেটর চালাতে ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ লিটার জ্বালানি প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশ কনজুমার অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের ফলে পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিয়ে ফসলে পানি দিতে হয়। এতে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এছাড়া লোডশেডিংয়েও সুফল নেই জ্বালানি খাতে। সামর্থ্যবানরা ঠিকই ডিজেল পুড়ে বিদ্যুতের সুবিধা নিচ্ছে। গরিবরা এখানেও ভুক্তভোগী।
সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্ধ করতে হবে জেনারেটর। প্রতিনিয়ত লোডশেডিং এলাকা তদারকি করতে হবে। রাজধানীতে লোডশেডিং হলেই মুহূর্তেই বাসা-অফিস-হাসপাতালে জেনারেটর চালু হয়ে যায়। পুরো এক ঘণ্টা ধরে চলে জেলারেটরগুলো।’
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘শতভাগ বিদ্যুতায়ন বাংলাদেশের অনেক বড় অর্জন। তবে নতুন করে জ্বালানির উৎস খুঁজতে আমাদের সাফল্য নেই। আমাদের দেশীয় গ্যাস ধীরে ধীরে কমে আসছে।’
জ্বালানির সংকটের বিষয়টি একটি ভ্রান্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের যে গ্যাস সম্পদ আছে সেটা যথেষ্ট অনুসন্ধান না করে, গ্যাস না তুলে, আমরা অন্যদিকে সমস্যা সমাধানে হাত-পা বাড়িয়েছি। যত হাত-পা বাড়াচ্ছি, সমস্যা তত বাড়ছে। আমরা গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান করতে পারলে বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট থাকবে না।