জ্বালানি তেলের নামমাত্র মূল্যহ্রাসে সুফল পাচ্ছে না জনগণ। ভোক্তা পর্যায়ে ফলাফল শূন্যের কোটায়। জ্বালানির দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে ডিজেলের আমদানি শুল্ক ও অগ্রিম কর কমিয়েছে সরকার। ফলে চার ধরনের জ্বালানির তেলের দাম পাঁচ টাকা কমিয়েছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল, পেট্রলসহ সমস্ত জ্বালানি তেলের দাম ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করে পাঁচ টাকা কমানো জনগণের সাথে উপহাস ছাড়া কিছু নয়। অবৈধ উপায়ে দাম বাড়ানো যেমন ভোক্তা স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তেমনি অবৈধ উপায়ে দাম কমানোও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ করে না। অবৈধ উপায়ে দাম বাড়িয়ে আবার কমানো মানুষকে বিভ্রান্ত করার নামান্তর। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে উচ্চ মূল্যেই রয়ে গেছে জ্বালানির দাম।
সংকটকালেও রাজস্ব আদায়ের বড় ক্ষেত্র জ্বালানি তেল। একদিকে বলা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) প্রতি লিটার ডিজেলে ১৯ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে সেই একই পণ্য থেকে কর বাবদ ২০ টাকার মতো রাজস্ব আদায় করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুমুখী প্রভাব বিবেচনায় জ্বালানি তেলকে রাজস্ব আদায়ের প্রধান লক্ষ্য করা উচিত নয়। এতে প্রভাব পড়বে সর্বগ্রাসী। লোকসান হচ্ছে বিপিসির এমন অজুহাতে গত আগস্টের শুরুতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এতে নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে হুহু করে। জনগণের গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে আগস্ট মাসের শেষ দিকে আমদানি শুল্ক কাঁটছাট করে ৪ শতাংশের মতো দাম কমানো হয়। তবে আমদানি শুল্কে ৫ শতাংশ ছাড় দেয়ার পরও রাজস্ব আহরণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে জ্বালানি তেল।
একদিকে বিপিসির দাবি, ডিজেলে প্রতি লিটারে ১৯ টাকা লোকসান হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি লিটার ডিজেলে দুই ধাপে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায় হচ্ছে ১৫ টাকা ৪২ পয়সা, কেরোসিনে ১৫ টাকা ৫৭ পয়সা, অকটেনে ১৮ টাকা ২৩ পয়সা আর পেট্রলে ১৭ টাকা ৫১ পয়সা।
পাশাপাশি বিপণন কোম্পানিগুলোর মার্জিন, বিপিসির উন্নয়নসহ বিভিন্ন তহবিলের অর্থ ধরলে গ্রাহকের ওপর ১৭ থেকে ২০ টাকার মতো চাপছে।
এছাড়া আমদানি পর্যায়ের শুল্কসহ প্রতি লিটারে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ টাকা। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কম থাকার সময় টানা সাত অর্থবছর ৪৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছিল বিপিসি। একই সাথে জ্বালানি তেলে বছরে ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স পাচ্ছে এনবিআর। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে সংকটকালেও বড় অঙ্কের রাজস্বের ভার চাপিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে রাখা যৌক্তিক কি-না।
এদিকে ডিজেলে লোকসান দাবি করলেও ভ্যাট-ট্যাক্স দেয়ার পরও পেট্রল-অকটেনে লিটারপ্রতি ২০ টাকার মতো লাভে রয়েছে বিপিসি। ইতোপূর্বে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল— বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেশি। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম কম।
তাই পাচার হওয়ার হুমকির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ে রিপোর্ট প্রদান করে প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল পেট্র্রল প্রাইসেস ডটকম। তাদের ওয়েব সাইটে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জ্বালানি তেলের মূল্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এতে আফগানিস্তানে বর্তমানে পেট্র্রলের দাম লিটার প্রতি ৮৮ আফগানি। বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য দাঁড়ায় ৯২.০৫ টাকা। দেশটিতে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১১৮ আফগানি বা ১২৩.৪৩ টাকা। ভুটানে পেট্রলের দাম প্রতি লিটার ১০০.৫২ রুপি বা ১২০.২৭ টাকা এবং ডিজেলের দাম ১২০.৬৮ রুপি বা ১৪৪.৩৯ টাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি ১০৪.১৮৩ রুপি বা ১২৪.৯২ টাকা। ডিজেলের দাম ৯৩.৪৭৫ রুপি বা ১১২.০৮ টাকা, কেরোসিন তেল ৬২.৭৩৩ রুপি বা ৭৫.২২ টাকা ও এলপিজি ৬৭.১৪৮ রুপি বা ৮০.৫১ টাকা।
নেপালে লিটারপ্রতি পেট্রলের দাম ১৮১ নেপালিজ রুপি বা ১৩৫.৩৬ টাকা, ডিজেল ১৭২ রুপি বা ১২৮.৬৩ টাকা ও কেরোসিন তেল ১৭২ রুপি বা ১২৮.৬৩ টাকা। মালদ্বীপে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ১৬.৫৫ রুপাইয়া বা ১০২.৬১ টাকা, ডিজেল ১৬.৭৭ রুপাইয়া বা ১০৩.৯৮ টাকা।
পাকিস্তানে লিটারপ্রতি পেট্রলের দাম ২৩০.২৪০ রুপি বা ৯৭.৪৮ টাকা, ডিজেল ২৩৬ রুপি বা ৯৯.৯২ টাকা এবং কেরোসিন ১৯৬.৫৪ রুপি বা ৮৩.২১ টাকা। অর্থনৈতিক সংকটে পড়া দেশ শ্রীলঙ্কায় প্রতি লিটার পেট্রল ৫৪০ শ্রীলঙ্কান রুপি বা ১৪২.০৩ টাকা, ডিজেল ৪৩০ রুপি বা ১১৩.০৯ টাকা এবং কেরোসিন ৮৭ রুপি বা ২২.৮৮ টাকা।
নামে মাত্র দাম কমানো সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ জনগণের কোনো উপকারেই আসবে না এতে। দাম কমে এমন একটি পরিবর্তন করা উচিত ছিল, যা পরিবহনে পরিবর্তন, সেচে অবদান রাখতে পারত। সব জায়গায় সুবিধা পেতো। এখন শুধু ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়েছে। যারা সরাসরি ডিজেলের ব্যবসা করে তাদের পকেটে লাভ যাবে। এটি প্রশাসনিক প্রাইসিং হয়েছে।
এতে সরকার রাজস্ব পাবে না। ব্যবসায়ী গ্রুপের পকেট ভারী হবে। জ্বালানি তেলের লিটারে পাঁচ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তকে তামাশা হিসেবে দেখছেন অনেকে। বিপিসির অনৈতিক ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করার যে প্রবণতা, সেটিকে জিইয়ে রাখবে। বিপিসি যে তার মুনাফা বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে, তার প্রমাণ জনগণ ইতোমধ্যেই দেখেছে। ১৫টি ব্যাংকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট করেছে তারা, ব্যবসা করছে, বিনিয়োগ করছে। একটি কোম্পানির ২৫ হাজার কোটি টাকা এভাবে সঞ্চয় হয়ে যায়, যা খরচের কোনো জায়গা নেই।
ভর্তুকি প্রত্যাহারের অজুহাতে এর আগেও তারা (বিপিসি) এতটা দাম বাড়িয়েছে, আর এখন কমানোটাও তাদের একই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। তাদের ওই সিদ্ধান্তটিকে টেকসই করার জন্য লোক দেখানো পাঁচ টাকা কমিয়েছে। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগেও লোক দেখানোর জন্য তিন টাকা কমানো হয়েছিল।
যদিও তখন তিন টাকার মূল্য ছিল, এখন পাঁচ টাকার তো কোনো মূল্যই নেই, ফকিরকে ভিক্ষাও দেয়া যায় না। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পর অন্যান্য যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে, তা যে আর কমবে না, সেটি অবধারিত সত্য।
২০১৬ সালে তিন টাকা কমানোর ফলে শুধু বাসমালিকরা ৯০০ কোটি টাকা লাভ করেছিলেন, এখন পাঁচ টাকা কমানোর ফলে তারা ভাড়া আর কত কমাবে। ওই পাঁচ টাকাও তাদের পকেটেই ঢুকবে। মানে— দাম কমানোর সুফল পুরোটাই ব্যবসায়ীদের পকেটেই যাবে। আর দ্রব্যমূল্যের ওপর যে কী প্রভাব পড়বে, তা বোধগম্য নয়।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তারা প্রশ্ন করেন— ৪৪ টাকা নিয়ে পাঁচ টাকা ফেরতের ভিত্তি নিয়েও। ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম লিটারে পাঁচ টাকা করে কমিয়েছে সরকার। কিন্তু ৪৪ টাকা নিয়ে পাঁচ টাকা ফেরতের সিদ্ধান্তের ভিত্তি কি?
এই মুহূর্তে যে সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে, তার ভিত্তি কি? কে নিচ্ছে এসব সিদ্ধান্ত? তারা বলেন, এটি কি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না আর্থিক সিদ্ধান্ত? এটি কি সামাজিক সিদ্ধান্ত? সিদ্ধান্তগুলো কোথায় হচ্ছে? এটি কি মন্ত্রিপরিষদে হচ্ছে, এটি এনার্জি কমিশনে হচ্ছে, এটি মন্ত্রণালয়ে হচ্ছে, নাকি ব্যক্তিগতভাবে হচ্ছে? না কোনো বিশেষ মহল এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? এসময় জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্তের জায়গা পরিষ্কার নয় দাবি করে তারা বলেন, ৩৪ থেকে ৪৪ টাকা নিয়ে পাঁচ টাকা ফেরত, এটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ কোন জায়গা থেকে কত ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে? কত অর্থের প্রয়োজন পড়ছে? তেলে কর আহরণ কত? কিছুই কিন্তু কেউ জানে না। শুধু যদি একটি মন্ত্রণালয়, একজন সচিবের মাধ্যমে মধ্যরাতে সিদ্ধান্ত দেন, দুই সপ্তাহ পর এটি করতে হবে— তিন সপ্তাহ পর এটি করতে হবে, তাহলে এমনই হবে।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলে ভোক্তাপর্যায়ে ফলাফল কতটুকু জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমানোর পর দেশে দাম বাড়ানো ছিল অযৌক্তিক। এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানোর দরকার ছিল না। এছাড়া সরকারের কাছে যথেষ্ট মুনাফা ছিল।
এরপরও তেলের দাম বাড়ানো অযোক্তিক কাজ হয়েছে। ৪০-৫০ টাকা বাড়িয়ে পাঁচ টাকা কমিয়ে জনগণের সাথে উপহাস করা হয়েছে। হঠাৎ এত বেশি দাম বাড়ানোর ফলে জনগণ যখন ক্ষুব্ধ তখন পাঁচ টাকা কমিয়ে জনরোশ কাটানোর ব্যর্থ চেষ্ট করেছে সরকার। মনে হয় সরকার জনগণকে বোকা মনে করেছে।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে জানান, ‘জ্বালানি তেলের দাম এত বেশি বৃদ্ধি করা যেমন অযৌক্তিক ছিল, তেমনি এখন পাঁচ টাকা কমানোও অযৌক্তিক হয়েছে। দাম বাড়ানো-কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। এবার জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়েছেন। ভোক্তা পর্যায়ে তেমন সুফল পাবে না।
এছাড়া যারা গাড়ির মালিক বা যারা সরাসরি তেল কিনেন তারা হয়তো সামান্য লাভবান হয়েছেন। অন্যরা এর সুবিধা পাবে না। সরকার রাজস্ব কমিয়ে পাঁচ টাকা দাম কমিয়েছে। ফলে এই পাঁচ টাকা ব্যবসায়ীদের পকেটেই যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকারের রাজস্ব খাত।’
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘যে হারে দাম কমানো হয়েছে এতে ভোক্তা পর্যায়ে লাভবান হওয়ার কথা নয়। বিআরটিএ ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও তেমন ফল নেই তাতে। আগে গায়ের জোরে অত্যধিক দাম বাড়ানো হয়েছিল। ফলে লঞ্চে যাত্রী কমে যাওয়ায় এখন ভাড়া কিছুটা কমিয়েছে কর্তৃপক্ষ।’