মিয়ানমারের রাখাইনে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মিকে দমাতে হামলা চালাচ্ছে দেশটির জান্তা। গত এক মাস ধরে ওয়ালিডং পাহাড়ের পূর্ব দিকে খ্য মং সেক পাহাড়ে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির (এএ) সাথে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী— জান্তার যুদ্ধ চলছে। ওয়ালিডং পাহাড় থেকে থেমে থেমে ছোড়া মর্টার শেলের বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে এপারের ভূখণ্ড।
ইতোমধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর ছোড়া গোলা দুদফায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও পড়েছে। দুবারই মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মোকে ডেকে এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। তবে এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সতর্কাবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় এপারের ভূখণ্ডে গোলা না পড়লেও ভূখণ্ড কাঁপছে ঠিকই। যে কারণে সীমান্তের এপারের বাসিন্দাদের উত্তেজনা কমছে না; বরং বেড়েই চলেছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্ত এলাকার মিয়ানমার অংশে গতকাল বৃহস্পতিবারও ফের গোলাগুলি হয়। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ছোড়া হয় ১২-১৫টি আর্টিলারি ও মর্টারশেল। তবে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত আকাশে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ফাইটার জেট কিংবা হেলিকপ্টারের ওড়াউড়ি দেখা না গেলেও সকাল ৮টা থেকে ভূখণ্ড কেঁপে ওঠায় তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, প্রায় এক মাস ধরে সীমান্তজুড়ে গোলাগুলি চলছে। আজও গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। মনে হচ্ছে সীমান্তে মর্টরশেল ছুঁড়ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে গুলির শব্দে তুমব্রু সীমান্ত কেঁপে উঠে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সকালে হঠাৎ পুরো ঘরবাড়ি কেঁপে উঠে। প্রথমে ভেবেছি ভূমিকম্প তবে কিছুক্ষণ পর বুঝলাম এটি মিয়ানমারের মর্টারশেল ছোড়ার আঘাতের শব্দ। এখন নিয়মিত গোলাগুলি হয়, আমাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) তারিকুল ইসলাম তারিক সংবাদমাধ্যমকে জানান, বিষয়টি শুনেছি। খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
চেয়ারম্যান আজিজ আরও বলেন, সংঘর্ষটা ক্রমান্বয়ে রাখাইন রাজ্যের পূর্ব দিকে (মংডু শহরের দিকে) ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দুই পক্ষের লোকজনের হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির ঘটনা আগের তুলনায় কমে আসায় ঘুমধুম সীমান্তের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করলেও আতঙ্ক যাচ্ছে না।
ওয়ালিডং পাহাড় থেকে থেমে ছোড়া মর্টারশেলের বিকট শব্দে এপারের ভূখণ্ডও কাঁপছে। তুমব্রু বাজারের দোকানপাট খোলা হলেও লোকজনের তেমন সমাগম ঘটছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে গেছে। বাংলাদেশ সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।
তবে গতকালের বিষয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজির) পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও এর আগে বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান জানিয়েছেন, ‘আমরা তথ্য পেয়েছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’
মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আরাকান আর্মি গত ২ আগস্ট রাখাইনের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ শুরু করে। সর্বশেষ ৩১ আগস্ট একটি ফাঁড়ি দখলের পাশাপাশি ১৯ পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে।
এছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে যায়। আরাকান আর্মির এসব কর্মকাণ্ডের কড়া জবাব দিতে সীমান্তবর্তী এলাকায় সংগঠনটিকে টার্গেট করে বিমান হামলা চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। জান্তা সেনারা শক্তি বৃদ্ধি ও কামান ব্যবহার করে ফাঁড়িটি পুনরায় দখল করার চেষ্টা করে। দখল চেষ্টায় মরিয়া জান্তা সেনারা গত ৩ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপির আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০ ও ৪১-এর মাঝামাঝি স্থানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দুটি যুদ্ধবিমান এবং দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার টহল দেয়।
এসময় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে প্রায় আট থেকে ১০টি গোলা আর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এর মধ্য থেকে দুটি গোলা এসে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে আনুমানিক ১২০ মিটার অভ্যন্তরে পড়ে। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি । ঘটনার পর ওই সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে যায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। পাশাপাশি নিরাপত্তা টহল জোরদার করা হয়। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী ওই এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের গোলা পড়ার ঘটনার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘মর্টারশেলগুলো হঠাৎ করে চলে এসেছে। তাদেরকে (মিয়ানমার) আমরা জিজ্ঞেস করেছি, তারা ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবে বলেছে।’ গতকাল নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির শব্দ এপারের লোকজনের কানে আসছে। এপারের বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি সতর্কাবস্থায় আছে। নাইক্ষ্যংছড়ির শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরটি পড়েছে ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কোনারপাড়া সীমান্ত এলাকায়।
এই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, সকাল ৮টা থেকে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের পেছনে মিয়ানমারের ওয়ালিডং পাহাড় থেকে থেমে ভারী অস্ত্রের গুলি ও মর্টারশেল ছোড়া হচ্ছে। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গুলিবর্ষণ হয়েছে। এতে অন্যান্য দিনের মতোই আতঙ্কিত ছিলেন আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা। তাদের ১৫ দিন পরপর আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ত্রাণসহায়তা দেয়। গোলাগুলি চললেও আজ ত্রাণসহায়তা দেয়া বন্ধ রাখা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা তরিতরকারি ও মাছ কেনার জন্য ছোট্ট একটি খাল পার হয়ে ঘুমঘুমের তুমব্রু বাজারে আসে। কেনাকাটা শেষে আবার আশ্রয়শিবিরে ফিরে যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের যাতায়াতের অনুমতি নেই। আবার মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে কেউ যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, এ বিষয়ে সতর্ক বিজিবি। গত ১০-১৫ দিনে মিয়ানমার থেকে কোনো অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে এই ইউপি সদস্য বলেন, ঘুমধুম ইউনিয়নের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। সেখানে বিজিবি পাহারা দিচ্ছে।
এদিকে তুমব্রু বাজারের কোনারপাড়া ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ের মধ্যভাগের জায়গাটুকু নো-ম্যানস ল্যান্ড। এখানে (শূন্যরেখায়) আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে পাঁচ বছর ধরে বাস করছে রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত চার হাজার দুই শতাধিক রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবিরের পাশ ঘেঁষেই কাঁটাতারের বেড়া। কাঁটাতারের দক্ষিণে পাহাড়ের সারি। পাহাড়চূড়ায় স্থাপন করা হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) একাধিক চৌকি। ঘুমধুমের তুমব্রু বাজার থেকে এসব খালি চোখেই দেখা যায়।
শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ আগে হয়েছিল ঘুমধুম সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের ৪০-৪১ ও ৩৯ সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকায়। তিন দিন ধরে দুই পক্ষের স্থলযুদ্ধ ওয়ালিডং পাহাড়ের পূর্ব দিকে সরে গিয়ে ঘন গাছপালার খ্য মং সেক পাহাড়ে চলছে।
সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র ও রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, বর্তমানে দুপক্ষের স্থলযুদ্ধ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ক্রমান্বয়ে পূর্ব-পশ্চিম দিকে (রাখাইন রাজ্যে) মংডুর দিকে সরে যাচ্ছে। খ্য মং সেক পাহাড় থেকে রাখাইন রাজ্যে মংডু জেলা শহরের দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। আর ঘুমঘুমের বিপরীতে ওয়ালিডং পাহাড় থেকে দক্ষিণে মংডুর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। মংডু থেকে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টার ওঠানামা করে পাহাড়ের আরাকান আর্মির লক্ষ্যবস্তুতে গুলি, বোমা, মর্টারশেল নিক্ষেপ করত। মংডুর শহরের পশ্চিমে চার-পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী অতিক্রম করলে বাংলাদেশের টেকনাফ শহর।