ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আবু বকর সিদ্দিক (৬২) গত সোমবার সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একই দিন অপর এক মাদক মামলার আসামি খোকন বেপারীও (৪২) হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। তার বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে।
দুই কারাবন্দি মৃত্যুর বিষয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমে জানান, ওই দুই ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। কারাগারের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা না থাকায় বন্দিরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারা অধিদপ্তরও রয়েছে বিপাকে। প্রতিনিয়ত নানা প্রক্রিয়া শেষে বন্দিদের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। দেশে ৬৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দি রয়েছে। এসব করাগারে অনুমোদিত ১৪১টি চিকিৎসকের পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র পাঁচজন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ কারাগারে বন্দিরা চিকিৎসাবঞ্চিত। চল্লিশোর্ধ্ব মানসিক রোগীর জন্য নেই অনুমোদিত চিকিৎসক। ধারণ ক্ষমতার তিন গুণেরও বেশি বন্দি থাকলেও কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারের হাসপাতালে অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসার জন্য কোনো চিকিৎসক নেই। ১০ শয্যার হাসপাতালটিতে সহকারী সার্জনসহ তিনটি পদ থাকলেও শুধু ফার্মাসিস্ট দিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। ফলে কোনো বন্দি গুরুতর অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য তাকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কিংবা রংপুরে স্থানান্তরিত করতে হয় বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, কারা হাসপাতালে একজন সহকারী সার্জন, একজন ডিপ্লোমা নার্স ও একজন ফার্মাসিস্টের পদ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি পদ শূন্য, পদ থাকলেও হাসপাতালটিতে সহকারী সার্জন ও ডিপ্লোমা নার্স পদে কেউ কর্মরত নেই। ফার্মাসিস্ট পদে একজন কর্মরত রয়েছেন। মূলত এই ফার্মাসিস্ট দিয়েই কারা হাসপাতালে অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়।
কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, কারা হাসপাতালটিতে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত মেডিসিন সরবরাহ রয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে— ইসিজি মেশিন, নেবুলাইজার ও পালস্ অক্সিমিটার। কারাগারের একটি সূত্র জানায়, চিকিৎসক না থাকায় কোনো বন্দি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তখন বন্দিকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়।
সাধারণ বন্দি হলে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সমস্যা না হলেও জেএমবি, সাজাপ্রাপ্ত কিংবা অন্য কোনো গুরুতর মামলায় বন্দি হলে তখন নিরাপত্তার প্রশ্ন আসে। বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ওই বন্দিকে চিকিৎসার জন্য বাইরে নেয়া হয়। অথচ কারা হাসপাতালে চিকিৎসক থাকলে এই বিড়ম্বনা কিংবা নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হতো না।
জেলা কারাগারের জেলার আবু সায়েম জানান, কুড়িগ্রাম জেলা কারাগার একটি ‘গ’ শ্রেণির কারাগার। এখানে সহকারী সার্জনের একটি পদ থাকলেও ওই পদটি শূন্য। শুধু ফার্মাসিস্ট পদে একজন কর্মরত আছেন।
কিভাবে অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসাসেবা হয়, জানতে চাইলে জেলার বলেন, ‘কারা হাসপাতালের জন্য সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি চিকিৎসক রয়েছেন। তিনি সপ্তাহে একদিন কারা হাসপাতালে আসেন। অন্য দিনগুলোতে কর্মরত ফার্মাসিস্ট তার (চিকিৎসকের) পরামর্শক্রমে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। কোনো বন্দি গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে আমাদের নিজস্ব পরিবহনে (ডাবল কেবিন পিকআপ) কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে পাঠাই। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে রংপুর মেডিকেল হাসপাতালেও পাঠানো হয়।’
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারের মোট ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জনের। তবে বেশির ভাগ কারাগারে প্রায় কয়েকগুণ বন্দি রয়েছেন এবং গত ২১ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত ৬৮ কারাগারে ৮৫ হাজার ৬৭৭ জন বন্দি রয়েছেন।
কারাবন্দিদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য ৬৮টি কারা হাসপাতালে সহকারী সার্জনের ৭০টি, মহিলা সহকারী সার্জনের ১২টি, প্যাথলজিস্ট ১২টিসহ মোট ১৪১ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব পদের বিপরীতে মাত্র পাঁচজন কর্মরত আছেন। অধিকাংশ কারাগারে শুধু ইসিজি পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। আর কয়েকটি কারাগারে এক্স-রে করা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অর্ধেকের বেশি বন্দির বয়স ৪০ বছরের বেশি। তাদের বেশির ভাগই নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত। এত এত বন্দির চিকিৎসার জন্য কারাগারে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনে মাত্র পাঁচজন
চিকিৎসক রয়েছেন। অথচ পদ রয়েছে ১৪১টি। এছাড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ৯৩ জন চিকিৎসক সংযুক্ত রয়েছেন, যাদের প্রয়োজন হলে ডেকে আনতে হয়। তারা সপ্তাহে দু-এক দিন কারাগারে গিয়ে চিকিৎসা দেন। তবুও সঙ্কট ৪৩ জন চিকিৎসকের। আর অনুমোদিত ১৪১ পদের বিপরীতে চিকিৎসক শূন্য ১৩৬টি।
অথচ একটি উপজেলা কমপ্লেক্সে ৩১ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসক থাকেন ১৮ জন। আর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য চিকিৎসক মাত্র দুজন। ১৪১ পদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৭টি, ময়মনসিংহে ছয়টি, রাজশাহীতে ১১টি, রংপুরে ৯টি, চট্টগ্রামে ১৭টি, সিলেটে ছয়টি, খুলনায় ১৫টি ও বরিশালে সাতটি চিকিৎসকের পদ রয়েছে।
কারা কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত চিকিৎসক সংকটের কারণে ঝুঁকি নিয়ে প্রায় প্রতিদিন দুর্ধর্ষ আসামিদের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হচ্ছে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কারাগারে অসুস্থতাসহ ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের বছর আরও ৭৫ জনের মৃত্যু হয়। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে জেলখানায় মারা গিয়েছেন কমপক্ষে ৪১৯ জন বন্দি।
কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রায় অধিকাংশ কারাগারে কয়েদিদের ইসিজি করার ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েকটি কারাগারে এক্স-রে করারও ব্যবস্থা আছে। কারাগারে ফার্মাসিস্ট, ডিপ্লোমা অ্যাসিসটেন্ট আছে। সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতিটি কারাগারে দুই থেকে একজন চিকিৎসক সংযুক্ত আছেন। তারা সপ্তাহে দুইদিন কারাগারে চিকিৎসাসেবা দেন। জরুরি প্রয়োজনে হলে ফোন দেয়া হলে আসে।
চিকিৎসক না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ আসামিদের চিকিৎসা প্রদান বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জঙ্গি মামলার আসামি অসুস্থ হলে বেশি ঝুঁকি নিতে হয়। দেশে তো সব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা আছে। তাই ঝুঁকি সত্ত্বেও আমরা সবার চিকিৎসার জন্য হাসপাপতালে নিয়ে যাই। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের সহায়তা করে থাকে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে মেডিকেল কোর গঠন পূর্ণাঙ্গরূপে শেষ হলে আশা করি আলাদা নিয়োগবিধি মেনে সব জায়গায় চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া যাবে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন। তখন জানানো হয় দেশের ৬৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বন্দির চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে প্রেষণে আসা অল্প সংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে। বিশেষ করে বন্দি থাকা মানসিক রোগীদের নিয়ে মহা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারা কর্তৃপক্ষ গুরুতর রোগীদের অনেকটা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিকেল ইউনিট গঠনের নির্দেশ দেন। এরপর কেটে গেছে অন্তত প্রায় সাড়ে তিন বছরের বেশি সময়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেই নির্দেশনার বাস্তবায়নও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
তবে নিয়োগবিধি চূড়ান্ত করাসহ নানা জটিলতায় সেই প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত ১৭ জন জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে বদলি থেকে শুরু করে বিধিতে কিছুটা জটিলতা রয়েছে। ফলে পূর্ণাঙ্গভাবে কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে বলা যাচ্ছে না।’