বিস্ময়কর কর্মপরিকল্পনা! আউয়াল কমিশনের জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপে। নির্বাচনের প্রথম লক্ষ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইচ্ছুক সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে যারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে শুধু তাদের নিয়েই ভাবনা। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে যারা এই কমিশনে অনাস্থা জ্ঞাপন করবে, নির্বাচন বর্জন করবে, স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না তাদের নিয়ে আপাতত ইসির ঘরে কি তাহলে কোনো চিন্তা নেই। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি তারা নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু তার আগেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা প্রশ্নমূলক আগাম ভাবনাযুক্ত হয়ে গেছে। সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ভয় আশঙ্কার জায়গা থেকে আগেই কর্মচিন্তা যুক্ত করা হয়েছে।
কমিশনের ভাষ্য, কোনো রাজনৈতিক দল যদি নিজেরা নির্বাচন বর্জন করে পর্দার আড়ালে অন্য রাজনৈতিক দলকে সমর্থন জানায় তাদের কিছুই করার নেই। কমিশন আহ্বান করলে, দাওয়াত দিলে কেউ না এলে তাদের জোর করে আনাও হবে না। ব্যালট এবং ইভিএম নিয়েও সাংঘর্ষিক বক্তব্য যুক্ত। ইভিএম ব্যবহারের যুক্তিতে ইসির ভাষ্য, ‘ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে ভোটের আগে-পরে ইচ্ছেমতো বাক্সে ব্যালট ভর্তি করা সম্ভব।’ কমিশনের এমন কথায় বাকি যে ১৫০ আসনে ব্যালটে ভোট হবে তা নিয়ে ভয় এবং আশঙ্কা রয়েছে বলে সচেতন মহল থেকে দাবি উঠেছে। ব্যালটে যদি ছিনতাই হওয়ার শঙ্কা ইসির থাকে তাহলে কেন ৩০০ আসনে ভোট হবে না, এ নিয়েও দেশের সর্বমহলে প্রশ্ন।
তবে এ নিয়ে ইসির কথা হচ্ছে, এখন হাতে সময় নেই। সুযোগ থাকলে আরও দুই-তিন বছর সময় পেলে তারা ৩০০ আসনেই ইভিএমে নির্বাচন করত। বর্তমানে যে সময় রয়েছে তার মধ্যে প্রশিক্ষণ দেয়া, জনশক্তিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার মতো সক্ষমতা নেই। ইসির আরেকটি বক্তব্যতেও দ্বিমুখী আচরণ দেখা গেছে। বর্তমান আউয়াল কমিশন কোনোভাবেই আগের কমিশনের কোনো ব্যর্থতার দায় নেবে না। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও এমন বক্তব্য দিয়েছেন।
গতকাল রোডম্যাপ কর্মপরিককল্পনা ঘোষণাকালে এক বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, আমরা এই কমিশনের সদস্য, আগের কমিশনের নয়। অতীতের নির্বাচন কমিশনের কি ভুলত্রুটি হয়েছে বা কি দুর্বলতা ছিল সেটার দায়িত্ব আমরা নেব না। আমাদের ভুলত্রুটি থাকলে আমরা শিক্ষা নেব। অতীতের কোন কমিশন কী করেছে আমরা তা জানতে চাই না, শিখতেও চাই না। আমাদের দায়িত্ব আমাদের কাছে।
কিন্তু দ্বাদশ পরিকল্পনায় বিস্ময়করভাবে দেখা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচন ও আগের কমিশনের ইভিএম স্বচ্ছতা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ইভিএমে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকার দুটি আসনে গড় ভোটের কাস্টিং হার ছিল ৪৪.১৬ শতাংশ।
এছাড়া চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, রংপুরের ভোটের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। রয়েছে ১২টি উপনির্বাচন ও ছয়টি সিটি নির্বাচনে ইভিএম সফলতার চিত্রও। এ নিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রশ্ন তোলেন— আগের কমিশনের সফলতা তুলে ধরা হলেও ব্যর্থতা কেন অস্বীকার করা হচ্ছে, এ নিয়ে কমিশনের কেউ স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেননি। অনেকেই বলেছেন, এমন বক্তব্যের ফলে দেশ-বিদেশে আগের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন ও দলিল তৈরি হবে।
গতকাল রোডম্যাপে ঘোষণা করা হয়েছে সম্ভাব্য ভোটের তারিখ। ২০২৩ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। একই বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়। মোট ১৫ দিনের মধ্যে ভোটের সময় রেখে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল উপস্থিত ছিলেন না। তিনি অসুস্থ বলে জানানো হয়েছে।
ইসির ১৯ পৃষ্ঠার কর্মপরিকল্পনায় পাঁচটি লক্ষ রাখা হয়েছে। নির্বাচনে অংশীজন সাত মাধ্যমের কাছে চাওয়া হয়েছে সহযোগিতা। ১৪টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জের উপায় রয়েছে ১৯টি।
এছাড়া সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পাশাপাশি ইভিএম ব্যবহার করবে শহরাঞ্চলের আসনগুলোতে। এমনটি জানানো হয়েছে। ইসির রোডম্যাপে আরও যা বলা হয়েছে— ১. আইন সংস্কার : ২০২২ আগস্ট থেকে ২০২৩ ফেব্রুয়ারি, ২. সংলাপ : ২০২২ মার্চ-২০২২ ডিসেম্বর, ৩. সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস : ২০২৩ জানুয়ারি-২০২৩ জুন, ৪. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : আগস্ট ২০২২ থেকে ২০২৩ আগস্ট, ৫. নতুন দল নিবন্ধন : ২০২২ সেপ্টেম্বর-২০২৩ জুন, ৫. ভোটার তালিকা : ২০২২ হালনাগাদ শুরু মে, ২০২৩ মার্চে চূড়ান্ত প্রকাশ, তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সংসদীয় আসন অনুযায়ী ৩০০ এলাকার তালিকা প্রস্তুত। ৭. ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ : ২০২৩ জুন-আগস্ট ২০২৩; তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে গেজেট প্রকাশ, ৮. প্রশিক্ষণ : ২০২৩ জানুয়ারি থেকে তফসিল ঘোষণার পরেও চলবে, ৯. পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন : জানুয়ারি ২০২৩ থেকে আগস্ট ২০২৩।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে বলেন, আমরা এই কমিশনের সদস্য, আগের কমিশনের নয়। অতীতের নির্বাচন কমিশনের কি ভুলত্রুটি হয়েছে বা কি দুর্বলতা ছিল সেটার দায়িত্ব আমরা নেব না। আমাদের ভুলত্রুটি থাকলে আমরা শিক্ষা নেব। অতীতের কোন কমিশন কী করেছে আমরা তা জানতে চাই না, শিখতেও চাই না। আমাদের দায়িত্ব আমাদের কাছে। আমরা তার জবাব দেব। আমরা যদি দেখি আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছি না, তাহলে সেই মুহূর্ত থেকে আমরা দায়িত্ব ছেড়ে দেব। আগামী নির্বাচনে পুলিশ প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেও জানান তিনি।
রাজনৈতিক দলের অনাস্থা ও অংশগ্রহণ সংকটে মো. আলমগীর বলেন, ভবিষ্যৎ কী হবে, যেহেতু নির্বাচনের এখনো এক বছর চার মাসের মতো বাকি আছে তাহলে আরও অপেক্ষা করতে হবে। কী করে ফেলতে পারব তা আগে বলে দেয়া যাবে না। ১৫০ আসনে আসনে শঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ইভিএম করে ১৫০ আসন সেভ করলাম। বাকি আসনগুলোতে আমরা ভালো অবস্থান নিতে পারব। যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়। এতে করে আমাদের ৩০০ আসনে আর রিস্ক থাকল না।
অর্থাৎ দেড়শ আসন আমরা নিরাপদে রেখে বাকি আসনে আমরা আমাদের বাহিনী বেশি খাটাতে পারব। আমরা পারলে আরও বাড়াতাম ইভিএম সংখ্যা। আমাদের এখন প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় নেই। আমাদের সামনে যদি আরও দু-তিন বছর সময় থাকত তাহলে আমরা ৩০০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করতাম। আমরা যদি ৩০০ আসনে নির্বাচন ব্যালটে করি তাহলে আমাদের অবশ্যই রিস্ক থাকবে। হয়ত এমনও হতে পারে আমরা এক সাথে নির্বাচন করব না। আমরা বিরতি দিয়ে দিয়ে করব। সংবিধানের শপথ নিয়েই আমরা কমিশন গঠন করেছি। আমরা অবশ্যই তা মেনে চলব। রোডম্যাপ বাস্তবায়নে যত বাধাই আসুক না কেন আমরা তা অতিক্রম করব। সম্ভাব্য ভোটের তারিখ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। তফসিল নভেম্বরে বলে জানান তিনি।
মো. আলমগীর আরও বলেন, আমরা ৩৯টি রাজনৈতিক দলকেই আহ্বান করেছি। সিডিউল করেই ডেকেছি। এখন কেউ যদি বলে আমরা নির্বাচন করছি না। আমরা নির্বাচনে যাব না। কেউ না আসলে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব অবশ্যই আমরা দেব না। যারা আসবে না তাদের দায়িত্ব আমরা নেব না। সেখানে আমাদের কোনো দায়িত্ব থাকবে না। যারা অংশগ্রহণ করে তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে আমরা তা দেখব। অনেক সময় অনেক দল রাজনৈতিক কৌশলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। এমনও হতে পারে তারা না এসে অন্য একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিয়েছে। তবে আমাদের এখনো কোনো রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে বলেনি কেউ নির্বাচনে আসবে না। আর কাউকে অবশ্যই নির্বাচন কমিশন জোর করে আনতে পারে না।
নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা বলেন, যদি কেউ মনস্থির করে থাকে আমরা যাব না, কোনোভাবেই অংশগ্রহণ করব না। অজুহাতের শেষ থাকবে না। আমি অসুস্থ, আমার পরিবারের অমুক অসুস্থ নানান অজুহাত থাকবে। যদি শুধু বলাই হয় যাব না, যাব না। আসার ইচ্ছেটা থাকতে হবে তো। কেউ কাউকে দাওয়াত দিলে সেই দাওয়াতটা গ্রহণ করার ইচ্ছে থাকতে হবে। আপনি আমাকে টানছেন, আমি আসছি না, তো কি করব! জোর করে তো আপনি কাউকে খাওয়াতে পারবেন না। জোর করে কাউকে খাওয়ানো যায় না। খাওয়ার জন্য ইচ্ছে থাকতে হবে তো। দেশের জন্য কিছু করতে হলে ভালো ইচ্ছে থাকতে হবে। ইচ্ছে না করলে তো কোনোভাবেই সম্ভব না। আমরা এখনো হাল ছেড়ে দিইনি। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। আমরা শুয়ে পড়িনি। কেউ আসতে হলে ইচ্ছে থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, আউয়াল কমিশন যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে তা একেবারে পক্ষপাতমূলক। কারণ এই কমিশন সংবিধান বুঝে না। আমাদের করতে হবে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন কিন্তু এখন তারা বলছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
এর আগের নির্বাচন কিংবা যে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনগুলা হয়েছে সেগুলো অংশগ্রহণমূলক ছিল। আসলে বলতে গেলে এই কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। রাজনৈতিক আস্থা নেই বিশিষ্ট নাগরিক-ব্যক্তিবর্গেরও। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হয় তাহলে হামলা-মামলা বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে এবং সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ কমিশনের রোডম্যাপে সেটি নেই।