দেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়ন ঘোষণার পরও

নতুন সংযোগ ১৫ লাখ!

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২, ০১:২৯ এএম
নতুন সংযোগ ১৫ লাখ!

দেশের বৃহত্তম পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শতভাগ জনগণকে বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ কেন্দ্র থেকে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা রয়েছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত মার্চ মাসে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার পর গত ছয় মাসে বেড়েছে ১৫ লাখ গ্রাহক। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে এক হাজার একর জমিতে নির্মিত হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের ১৩তম দেশে পরিণত হয়েছে। কার্যত শতভাগ জনগণ শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় তখনো আসেনি। ফলে ওই ঘোষণার পরও প্রতি মাসে বাড়ছে বিদ্যুৎ গ্রাহক। এখনো অফগ্রিড দ্বীপাঞ্চল এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে রয়েছে। সে দ্বীপগুলোতে কাজ দ্রুত শেষ করতে সমপ্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার সময় গত মার্চে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল চার কোটি ২১ লাখ। এপ্রিল মাসে এ গ্রাহক বেড়ে দাঁড়ায় চার কোটি ২২ লাখ। মে মাসে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক বেড়ে দাঁড়ায় চার কোটি ২৭ লাখ, জুনে চার কোটি ২৯ লাখ, জুলাইয়ে চার কোটি ৩২ লাখ ও আগস্টে চার কোটি ৩৪ লাখ। সর্বশেষ চলতি সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যুৎ গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৩৬ লাখ।

এক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন জোর করে করা একটি ব্যাপার। শতভাগ বিদ্যুতায়নের সক্ষমতা আমাদের নেই। তড়িঘড়ি করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দিকে যাওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তাদের পুরো সম্পদ ও মনোযোগ সেদিকেই রাখতে হয়েছে। ফলে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। শুরুতে কিছুটা ঢিমেতালে চললেও উপজেলাভিত্তিক শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়ার পর কাজে গতি আসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সাল থেকেই ধাপে ধাপে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসা উপজেলাগুলো উদ্বোধন করতে শুরু করেন। এতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের এই কার্যক্রম আরও গতি পায়।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে সব উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেয়া হয়।

সেই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা করে আরইবি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেয় আরইবি। ধাপে ধাপে কাজের বিলম্বে এখনো শতভাগ বিদ্যুৎ বাস্তবায়ন হয়নি।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের গত জুন মাসের সমন্বয় সভায় জানানো হয়, পিডিবির অধীনে নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া ও কুতুবদিয়ায় বিদ্যুতায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে হাতিয়ায় একটি ও দুটি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। আর কুতুবদিয়ায় ৩৩ কেভি সাবমেরিন কেবল দিয়ে গ্রিড সংযুক্ত করা ও নিঝুম দ্বীপকে হাতিয়ার সাথে যুক্ত করার জন্য ১১ কেভি সাবমেরিন কেবলে কাজ শুরু হয়েছে।

এ ছাড়া ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) আওতাধীন মনপুরা দ্বীপে শতভাগ বিদ্যুতায়নের জন্য আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) মডেলে গৃহীত তিন মেগাওয়াট সোলার ব্যাটারি ডিজেল হাইব্রিড বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মুজিববর্ষের মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার জন্য মার্চে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়। দ্বীপ ও পাহাড়ি কিছু এলাকায় এখন শতভাগ বিদ্যুতায়নে কাজ চলছে। তবে খুব দ্রুতই কাজ সম্পন্ন করা হবে বলে জানা যায়। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহকসংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখ। ১৩ বছর পর তিন কোটি ১৩ লাখ বেড়ে বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা হয়েছে চার কোটি ২১ লাখ।

এছাড়া ২০০৯ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, বর্তমানে এ ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ)। সরকারের ১৩ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৭টি থেকে বেড়ে বর্তমানে ১৫২টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।  

অন্য দিকে ‘বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির তথ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৪টি। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫১২ মেগাওয়াট। তবে ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হয় ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে চার কোটি ৩৬ লাখের বেশি বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এক যুগ আগে বিদ্যুৎ গ্রাহকসংখ্যা ছিল এক কোটি ২৩ লাখ।

এই মধ্যবর্তী সময়ে দুই কোটি ২৮ লাখ বিদ্যুৎ সংযোগ বেড়েছে। দেশের যেসব স্থানে গ্রিডের বিদ্যুৎ সরাসরি পৌঁছানো যায়নি সেখানে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সংযোগ ও সোলার মিনিগ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বিপুলসংখ্যক জনগণকে সংযুক্ত করার পর এখন টেকসই, নিরবচ্ছিন্ন এবং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, ‘শতভাগ বিদ্যুতায়নে তাড়াহুড়া করা হয়েছে। এটি জোর করে করা একটি ব্যাপার। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন তখনই হবে, যখন আমরা উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রস্তুত হতে পারব। গ্রামের মানুষ তো শহরের মানুষের তুলনায় অনেক পরে বিদ্যুৎ পেয়েছে। আরও কিছুদিন অপেক্ষা তো তারা করতেই পারত।’