দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভোটে মাঠ ছাড়বে না বিএনপি। হামলা-মামলা, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এবার টিকে থাকবে। এখন থেকেই তিন কৌশলে দলটির ঘরে ভোটের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। দলটির শীর্ষ নেতাকর্মীরা বলছেন, মাঠ দখলে সরকারকে চাপে রাখতে ভোটের আগ পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে ঘোষিত কর্মসূচি চলতে থাকবে। এর মাধ্যমে আন্দোলনে সক্রিয় প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করবে এবং সরকারের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা কূটনৈতিক দরবারে তুলে ধরা হবে।
গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে রাজধানীর পল্লবীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়; যান চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। হামলায় প্রায় ৭৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন; গ্রেপ্তার হয়েছেন ৮ জন। হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিএনপির দপ্তর থেকে বলা হয়েছে , যুবলীগের তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী, রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের রজ্জব আলী, কাশেম মোল্লা, তুহিন, শেখ মান্নান, মো. লিটু, সালাহউদ্দিন রবিন, ইসহাক মিয়া, মোবাশ্বের চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন টেঙ্গু, জাকির হোসেন, মো. খোকন, মো. ইব্রাহিম, খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র হামলা হয়েছে।
এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির সমাবেশে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরসহ সব মহানগর, জেলা-উপজেলায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হবে বলে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রাজধানীতে সেদিন মহানগর বিএনপি উত্তর-দক্ষিণের যৌথ উদ্যোগে বেলা ৩টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ হবে।
এছাড়া বিদ্যুতের নজরবিহীন লোডশেডিং, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি এবং ভোলায় আব্দুর রহিম ও নারায়ণগঞ্জে শাওন হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপির সমাবেশ চলছে। গতকাল ঢাকা জোন-৬-এ সমাবেশ চলে। সেখানে দলের স্থায়ী কমিটিসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণে সারা দেশের প্রতিটি আসনে জরিপ পরিচালনা করছে বিএনপি। একটি পেশাজীবী সংগঠনের মাধ্যমে প্রার্থীদের খোঁজে জরিপের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আগামী দু’এক মাসের মধ্যে তারা প্রার্থীদের আমলনামা কেন্দ্রের কাছে জমা দেবে।
এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটে থাকতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান এবং যোগাযোগ বাড়ানোসহ সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি ভোটে যাবে— আগ্রহী প্রার্থীদের এমন বার্তা দেয়া হয়েছে। তার আগে বর্তমান সরকারের পতনে রাজনৈতিক অবস্থান, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং ইভিএম বাতিলসহ সাময়িক ইস্যুতে সোচ্চার থাকা হবে। নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে শক্তি সঞ্চয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তার গতি ধরে রাখতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এখন জামায়াত, এলডিপি ও জাতীয় পার্টি নিয়েও আন্দোলনের চিন্তা করছে বিএনপি। এ নিয়ে খুব শিগগিরই একটি রূপরেখা তৈরি হচ্ছে দলটিতে। সেখানে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, ইভিএম বাতিল এবং সুষ্ঠু নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবি যুক্ত থাকবে।
এছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত রেখেছে দলটি। এরই মধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছে, বাংলাদেশে আগামীর রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারণে কূটনৈতিক তৎপরতাও প্রয়োজন। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশের দূতাবাসের বিএনপির সাথে বৈঠকে রাজনৈতিক খুনের প্রতিবাদ জানানো হয়। নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠক করে ইসিকেও সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা নিতে তাগিদ দেয়া হয়।
মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম আমার সংবাদকে বলেন, সরকারকে বলছি, এই হামলার ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমাদের একটাই কথা, মাঠে আমরা এখনো নামিনি, নামছি। মাঠ থেকে গুলি করে মৃত্যু হলেও আমাদের ওঠাতে পারবে না। সরকারকে চিন্তা করতে হবে তারা লাশ চায়, না অন্য কিছু চায়।
মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান আমার সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগ-যু্বলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আক্রমণ করেই যাচ্ছে। এসব আক্রমণ করে কোনো লাভ হবে না আমাদের সিরিজ কর্মসূচি চলবে। ঢাকায় আমাদের যে কর্মসূচি ২৮ তারিখ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেই কর্মসূচি চলবে। যে কেনো প্রতিকূলতার মধ্যে এই কর্মসূচি ইনশাল্লাহ অব্যাহত থাকবে। এ সরকার হটিয়ে তবেই এবার ঘরে ফিরব।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ যে কাজটি করতে চাচ্ছে, তা হচ্ছে যেন নির্বাচনের কোনো পরিবেশ তৈরি না হয়। সে জন্য তারা হামলা-মামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গতকালও আমাদের কর্মসূচির ওপর পুরো সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হয়েছে। আর আগে আমাদের দুজন নেতা পুলিশের গুলিতে খুন হয়েছেন। মূলত এ সরকার আবারও একটি নির্বাচন করতে চায়, যে নির্বাচনে কোনো বিরোধী দল থাকবে না। কিন্তু এবার আমাদের নেতাকর্মীদের ত্যাগ ও অশ্রু বৃথা যেতে দেয়া হবে না। আমাদেরকে আন্দোলনের মাধ্যমেই ভয়াবহ এই দানবীয় সরকারকে হটাতে হবে। এই সরকারকে সরাতে আমরা ইতোমধ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অতিদ্রুত আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করে আমরা জাতির সামনে ঘোষণা দেব।