দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনি মাঠ প্রস্তুত করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনি মাঠে দলটির টার্গেট বিরোধী পক্ষ বিএনপি নয়— ক্ষমতাসীন দলটির টার্গেট অহিংস বা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা।
আগ-বাড়িয়ে কোনো দলকে দমিয়ে রাখা নয়। বিএনপিকে ভোটের মাঠে রেখেই নির্বাচনে জয়লাভ করা। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। যার কারণে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে চায় দলটির হাইকমান্ড।
দ্বাদশ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতি। গত তিন সপ্তাহ ধরে সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। প্রায় দুই বছর নীরব থাকার পর সারা দেশে দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে। বেশ কয়েক স্থানে ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলের তীক্ষ্ম নজরদারি ফুটে উঠেছে।
একাধিক সূত্র মতে, আগামী নির্বাচন সামনে রেভে অনেকটা কৌশলী ভূমিকায় রয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। নির্বাচনকে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেবে না। নির্বাচনি পরিবেশ কীভাবে অহিংস রাখা যায়, সে পরিকল্পনা করছে দলটির নেতারা। কিন্তু নির্বাচনে শক্ত বিরোধী শক্তি বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে জটিলতা কাটছে না।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে দলটির নেতারা। যার কারণে বিএনপির গতিবিধি লক্ষ্য রেখেই নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণ করবে দলটি। দলটিকে ভোটের মাঠে রাখতে নমনীয় ভূমিকা দেখানোর কথাও ভাবা হচ্ছে।
এরই অংশ হিসেবে সারা দেশে বিএনপিকে কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বিএনপি কোথাও সহিংসতা করলে প্রশাসনই ব্যবস্থা নেবে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহিংসতায় না জড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। এর আগে আলোচনায় বসতেও চান না দলটির নেতারা। এ ছাড়া দলের চেয়ারম্যান দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহারেরও দাবিও রয়েছে। এসব শর্ত পূরণ হলেই নির্বাচনে আসবে বিএনপি।
বিএনপির একটি সূত্র মতে, মুখে যাই বলুক, বাস্তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে কাজ করছে দলটি। এসব কাজ চলছে দলের অভ্যন্তরে। দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে থাকা দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান নিজেই মনোনয়নের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। নির্বাচনকালীন সময়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সে নির্বাচন কখনোই গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের মানুষ এ নির্বাচনে অংশ নেবে না।
আ.লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় সূত্র মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। সংবিধানের আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনের আগে বর্তমান মন্ত্রিসভা ছোট করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে। নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করবে।
নির্বাচন কমিশনও তাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ গোছাতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। তৃণমূলে দলকে শক্তিশালী করতে সম্মেলন চলছে জোরেশোরে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রতিটি ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন করা হচ্ছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়াদোর্ত্তীণ সহযোগী সংগঠন ও মূল দলের সম্মেলনও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সংসদীয় আসনগুলোতে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছে দলটির হাইকমান্ড।
সর্বশেষ গতকাল দুপুরে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলী ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের সাথে বিবাদে না জড়ানোর কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিএনপির সাথে সংঘাত না করে, সংগঠন গুছিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করতে বলা হয়েছে।
সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের দলের নেতাকর্মীদের বলছি— নেত্রীর (সভাপতি শেখ হাসিনা) নির্দেশের বাইরে গিয়ে কেউ যদি হামলায় জড়িয়ে পড়েন তাদের ছাড় দেয়া হবে না। এসব করলে সরকারের ওপর এসে দায় পড়বে, এ জন্য কিন্তু আমরা ছাড় দেবো না। কোনো খারাপ কাজ আমাদের নেত্রী সহ্য করেন না।
বৈঠকে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর আমার সংবাদকে বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরির জন্য বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগকে উসকানি দিচ্ছে। তাদের উসকানিতে যেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পা না দেয়, সে বিষয়ে মহানগর উত্তর-দক্ষিণসহ সব সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে নির্দেশনা দেয়া হবে। একই সাথে বিএনপির আন্দোলন বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
ক্ষমতাসীন নেতারা বলছেন, ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। সহিংসতা এগিয়ে ভোটের মাঠে বিএনপিকেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। দশম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল। যা নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু সংবিধান রক্ষায় এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। একাদশ নির্বাচনে একটি অংশ ভোটে আসলেও তা নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। আগামী নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না আওয়ামী লীগ।
আরেকটি সূত্র মতে, বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ধরনের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতেই হুমকি-ধমকি ছেড়ে বিএনপি নির্বাচনে আসবে। গত দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি রাজনৈতিক ভুলের মাশুল দিচ্ছে। পুনরায় সে ভুল করলে দলটির অস্তিত্বশূন্য হয়ে পড়বে।
এরপরও বিএনপি নির্বাচনে না এলে তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলা হবে। আগামী নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের আকার বাড়বে এটি নিশ্চিত। সমমনাদের জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় পায় মহাজোট। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচন বিএনপি জোট বর্জন করলে মহাজোট থেকে বেরিয়ে জাতীয় পার্টি আলাদা অংশ নেয়।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নিলেও জাতীয় পার্টি আলাদা অংশ নেয়। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আবারো গঠিত হতে পারে মহাজোট। তবে সব কিছু নির্ভর করছে বিএনপির ওপর। দলটির গতিবিধি ফলো করে সামনে এগোবে আওয়ামী লীগ। বিএনপি না এলেও তৃতীয় জোটকে সামনে এনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বিএনপির রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করার কারণে বিএনপি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সব সময় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বিশ্বাসী। আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচন চাই। আশা করি বিএনপি নির্বাচনে আসবে। না এলেও নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে।