বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানি সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানায়। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী জেলায় চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের হিড়িক। লোক দেখানো তিতাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের আড়ালে চলছে রমরমা বাণিজ্য। এতে জড়িত খোদ তিতাস কর্মকর্তাসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা। গ্যাস চুরির অভিযোগে ইতোমধ্যেই তিতাস ১২ কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দিয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় সারা দেশে এমন লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে।
এদিকে বৃহত্তর গ্যাস সরবরাহ কোম্পানি তিতাস বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। নির্মাণাধীন বাড়ির ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের অর্থ দিলেই
মিলছে নতুন গ্যাস সংযোগ। প্রায় এক দশক থেকে গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে না তিতাস কোম্পানি। নতুন বাসাবাড়ি নির্মাণ করে মালিকরা গ্যাসের জন্য হাহাকার করছেন।
একাধিক বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই সময়ে বাড়ি করে বড়ই ঝামেলায় পড়েছি। তিতাস নতুন সংযোগ দিচ্ছে না। গ্যাস সংযোগ না থাকলে ভাড়াটিয়া পাওয়া যায় না। ভাড়াটিয়া পেলেও অনেক কম দামে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হচ্ছে।
এদিকে প্রতি বছর লাখ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ কেটে দেয় দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (তিতাস)। দিনের বেলায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও রাতেই আবার সংযোগ দেয়া হয়।
তিতাস কর্মকর্তা সূত্রে জানা জায়, চলতি বছর অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এই বছরের জানুয়ারি থেকে আদাজল খেয়েই মাঠে নেমেছে তিতাস। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। সাথে মামলা ও জরিমানা থাকছেই। যেকোনোভাবে অবৈধ গ্যাস সংযোগ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে চায় তারা। তিতাসের অব্যবস্থাপনার ফলে অনেক ক্ষেত্রে অবৈধদের জন্য বৈধদেরও তিতাসের শাস্তি ভোগ করতে হয়।
গত মে মাসে রাজধানীর কামাঙ্গীরচরে বিল বকেয়া ও অবৈধ সংযোগের অজুহাতে কয়েকটি ওয়ার্ডের প্রায় এক লাখ আবাসিক গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তিতাস। এর মধ্যে অনেক বৈধ গ্রাহকও রয়েছেন। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন অবৈধের পাশাপাশি বৈধ গ্রাহকরাও।
এলাকাবাসী বলেছেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ খুঁজে বের করে তা বিচ্ছিন্ন করতে বৈধ গ্রাহকদের কোনোভাবেই ভোগান্তিতে ফেলতে পারে না তিতাস। যদিও তিতাস কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে অটল। পরে স্থানীয় প্রতিনিধি ও তিতাস কর্মকর্তার সমন্বয়ে প্রায় এক মাস পর সমঝোতায় এসেছে। বর্তমানে তিতাস কোম্পানি ১৩ হাজার ২৩৮ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যেমে গ্যাস সরবরাহ করছে।
তিতাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৩।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৬৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে তিতাস। তন্মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৯৯টি ও তিতাসের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে ৬৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। ৫৭১টি স্থানে এসব অভিযান পরিচালনা করে পাইপলাইন ও অনুমোদনহীন চুলা অপসারণ করা হয়।
এসব অভিযানে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি বকেয়া আদায়ও করা হয়। চলতি বছরেই দুই লাখ ২৩ হাজার ৩২৯টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি ২২০ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার অবৈধ লাইনও অপসারণ করে তিতাস। এই সময়ে শিল্পে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ২৯৩টি। এগুলোর মধ্যে অবৈধ ব্যবহারের দায়ে ১৮০টি এবং বকেয়ার কারণে ১১৩টির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার বিভিন্ন গ্রামে চলছে অবৈধ সংযোগে।
সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা হলেও এখনো অব্যাহত রয়েছে অবৈধ সংযোগ। এর নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবৈধ গ্যাস লাইনের ছড়াছড়ি। নতুন করে আবাসন প্রকল্পের পাঁচ শতাধিক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস। এসময় জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ চুলা ও রাইজার।
সম্প্রতি ফতুল্লার একটি আবাসিক প্রকল্পে তিতাসের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে। এতে বিচ্ছিন্ন করা হয় কয়েকশ অবৈধ সংযোগ। ওই প্রকল্পের অধীনে দুই শতাধিক ভবনের ৬০ শতাংশ গ্যাস সংযোগই ছিল অবৈধ। তিতাস কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রকল্পটির প্রতিটি ব্লকে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত বহুতল ভবনের বেশির ভাগেই ছিল গ্যাসের অবৈধ সংযোগ।
কয়েকটি বাড়িতে ১০টি চুলার অনুমোদন থাকলেও ব্যবহার করা হয় দু-তিনগুণ বেশি অবৈধ চুলা। তবে বৈধতার কথা বলে তিতাসের কিছু কর্মকর্তা ও ঠিকাদার প্রতিটি সংযোগ দিতে দুই থেকে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন বলে দাবি গ্রাহকদের। অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহারকারীরা জানান, যেসব অফিসার আসছেন তারাই টাকা নেন। তাদের ফান্ডে প্রতি মাসে এক কোটি টাকা জমা হয়। প্রতি মাসে ভাতা পর্যন্ত যায় অফিসারদের কাছে।
এদিকে তিতাস কর্তৃপক্ষ জানায়, অবৈধ সংযোগ প্রদানকারীদের চিহ্নিত করে দিলে, তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের নামে কোনো অভিযোগ দেয়া হলে উপযুক্ত শাস্তি দিতে তিতাস কর্তৃপক্ষ বদ্ধপরিকর। তিতাস কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ ও বকেয়াজনিত কারণে ছয় মাসে চার জেলায় সোয়া দুই লাখ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এ সময়ে অভিযান চালানো হয়েছে ১৬৪টি। পাইপলাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ২২০ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও তিতাস বোর্ডে পরিচালক প্রকৌ. মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, তিতাস এলাকায় বছরের শুরু থেকেই অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নে তিতাস ভালোভাবে অভিযানে নামে। গত ছয় মাসে দুই লক্ষাধিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে অবৈধ ও বকেয়াজনিত সংযোগ বিচ্ছিন্নও করা হয়েছে। এবার বৈধ গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে তিতাস। মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ গ্যাস ব্যবহরে কোনো অন্যায় প্রশ্রয় দেয়া হবে না। আপনার আশপাশে কোনো অবৈধ সংযোগ থাকলে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন।
এ প্রসঙ্গে ক্যাবে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মন্তব্য করেন, তিতাস অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নে টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এই টাস্কফোর্সের ওপর আমাদের কোনো ভরসা নেই, কারণ আপনারা এত বছরেও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজটি শেষ করতে পারেননি। গ্রাহক-তিতাস কর্তৃপক্ষের পরস্পর দোষারোপের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো তিতাস কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ঠিকাদার ও প্রভাবশালীরা জড়িত।
এসব অবৈধ সংযোগে তিন-চার লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর এসব অর্থের ভাগ পান প্রত্যেকে। অবৈধ গ্রহকদেরকে এক ধরনের টোকেন না কর্মকর্তাদের ভিজিটিং কার্ড দেয়া হয়ে থাকে। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা করা হলে এসব অবৈধ গ্রাহক টোকেন প্রদর্শন করলে আর লাইন কাটা হচ্ছে না।
আর এভাবেই তিতাস কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীর ক্ষমতার কারসাজিতে বেড়েই চলছে অবৈধ সংযোগ। আর সহজেই অবৈধ গ্রাহকরা রেহাইও পাচ্ছেন সহজেই। বাণিজ্যিক নগরী নারায়ণগঞ্জে অবৈধ গ্যাস সংযোগের ছড়াছড়ি। এক দিকে চলে বিচ্ছিন্ন অভিযান, অন্য দিকে চলে অবৈধ সংযোগ। যত্রতত্র এসব গ্যাস সংযোগের কারণে সরকার হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব।
বন্দরনগরী নরায়ণগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব অবৈধ সংযোগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এসে হামলার শিকার হয়েছেন তিতাসের অনেক কর্মকর্তা। এরকম ঘটনা নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক ঘটনা ঘটেছে। অবৈধ সংযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে একাধিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক জন জানায়, সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া ও শম্ভুপুরা ইউনিয়নে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন ছাত্রনেতা সোহাগ রনি, স্থানীয় ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মজিবুর রহমান ও আশেক আলী, তিতাস গ্যাসের ঠিকাদার পরিচয়দানকারী জাহাঙ্গীর, পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ হোসেন।
গত মার্চে এক অভিযানে বাধা দেয় স্থানীয়রা। তারা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে তিতাসের দুটি গাড়ি ভাঙচুরসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের ওপর হামলা করে। এ সময় তিন শ্রমিক আহত হন।