ক্লাস-হোমওয়ার্ক-কার্টুন। বর্তমানে এই হলো একটি শিশুর জীবন। ওদের জীবনে নদী, ফুল, আকাশ কিংবা পাখি কিছুই নেই। মা-বাবার সাথেও যে তাদের খুব একটা কথাবার্তা হয় তা-ও না। পরিবারের বাকি সবাই টিভি সিরিয়াল আর খেলার চ্যানেলে ব্যস্ত। একে অপরের পাশে বসে থাকলেও যেন অপরিচিত সবাই। এভাবে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর আদিম সামাজিক সংগঠন-পরিবার। সময়ের চাকা ঘুরে স্মার্ট টেকনোলজি আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে। উন্নতমানের মোবাইল, কম্পিউটার, টেলিভিশন, গেমিং ডিভাইসসহ কি নেই প্রযুক্তির এই জাদুবাক্সে! প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রা সহজ ও গতিশীল করলেও বিনিময়ে কেঁড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। যে বৃদ্ধ-নিঃসঙ্গ বাবা শেষ বয়সে স্মার্ট ফোনে বুঁদ হয়ে থাকা সন্তান অথবা নাতনিকে কাছে ডাকলেও সাড়া পাননা তিনিই জানেন কত নির্মম একাকিত্ব। যে মা শত চেষ্টার পরও স্মার্টফোনে আসক্ত সন্তানকে পড়ার টেবিলে আনতে ব্যর্থ; তিনিই জানেন কত ভয়ানক প্রযুক্তির ছোবল। অনলাইন নির্ভর এমন আসক্তি এখন আর কোনো কল্পনা নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে আজ যেখানে যত অস্তিরতা, হিংস্রতা ও নেতিবাচকতা রয়েছে তার অন্যতম প্রধান কারণ এই ভার্চুয়াল আসক্তি। অনলাইন নির্ভর এ আসক্তি একটু একটু করে ধ্বংস করে দিচ্ছে ব্যক্তির নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধন ও বিশ্বস্ততা, সামাজিক সমপ্রীতি ও সহমর্মিতার মতো উৎকর্ষতার চিহ্নগুলো। একই সাথে মানসিক বিষণ্নতারও বড় কারণ হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি আসক্তি। ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহারের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে যুক্তরাজ্যর রয়্যাল সোসাইটি ফর পাবলিক হেলথ। নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে এমন ১৪-২৪ বছর বয়সি এক হাজার ৫০০ জন তরুণ-যুবক এতে অংশ নেন। এতে দেখা যায়, এদের শতকরা ৯১ জনই সোশ্যাল মিডিয়ায় এতটাই আসক্ত, যা সিগারেট বা অ্যালকোহল আসক্তির চেয়েও বেশি। এসব আসক্তি থেকেই আবার পরিবার থেকে বিছিন্ন হওয়ার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন অনেকে।
সাইকোলজিক্যাল জার্নাল রিপোর্টের ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ট্রমাতে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, ফেসবুক ব্যবহার করার দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে এমন মানুষের প্যাটার্নের সাথে মিলে গেছে মাদকদ্রব্য ও জুয়ায় আসক্ত মস্তিষ্কের প্যাটার্ন। অপরদিকে যুক্তরাজ্যর ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব শিশুরা দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সময় স্ক্রিনের সামনে কাটায় তারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ অ্যান্ড প্রিভেনশন বলছে, ২০১০ সাল থেকেই ১৩-১৮ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন ও প্রযুক্তি পণ্যর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বিষণ্নতায় ভোগা ও অত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে গেছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে যা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬৫ ভাগে। যেসব কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোন বা অন্যান্য ডিভাইসে দিনে পাঁচ ঘণ্টার অধিক সময় কাটাচ্ছেন তাদের ৪৮ ভাগ অন্তত একবার হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
দ্য স্পাইনাল জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘক্ষণ ঝুঁকে স্মার্টফোন ঘাড়ে ক্রমাগত চাপ পড়ে। এ চাপের পরিমাণ একজন ব্যক্তির মাথার ওজনের প্রায় ছয়গুণ। ফলে স্মার্টফোন আসক্তরা আক্রান্ত হচ্ছে ‘টেক্সট নেক’ নামক ঘাড়ব্যথায়। এদিকে আমেরিকার ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়া, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের কারণও হচ্ছে দীর্ঘসময় ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে থাকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অতিমাত্রার প্রযুক্তি নির্ভরতা মানুষের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। একই সাথে পারিবারিক বন্ধন থেকেও আলাদা করে দেয়। এর ফলে মানসিক অবসাদ, হতাশা, এমনকি আত্মহত্যার মতো ভয়ানক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ্? এহসান হাবীব আমার সংবাদকে বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্বায়নের একটি বড় উপকরণ। বিশ্বায়নের ধারনার ক্ষেত্রে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকার কথা সবসময় বলি। তবে এই শতাব্দীর মানুষ হিসেবে টেকনোলজির প্রভাব থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই। ক্ষুদ্রতর পরিসরে চিন্তা করলে দেখা যাবে— ফেসবুক বা অন্য সকল সোশ্যাল মিডিয়া সমাজের বৃহৎ মানুষের মনোজগতের মাঝে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মানুষকে ব্যক্তিসত্তাহীন করে তুলেছে। একই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের একটি ফাইবার ভুবন তৈরি করেছে; যেখানে এর ব্যবহারকারীরা মানসিকভাবে বা আবেগপ্রসূত এর সাথে ভীষণভাবে সংযুক্ত রয়েছে। প্রযুক্তি এ সুযোগটা এমনভাবে করে দিয়েছে যে, খুব সহজেই এ আসক্তি থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। সারা দিনে মোট সময়ের বেশির ভাগই ফেসবুকিং করে অথবা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করে কাটছে। ফলে ভাসমান এক জগতে আমরাই প্রযুক্তিতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি।
এর ফলে সরাসরি বন্ধুদের সাথে কথা বলা, বই পড়া, সংবাদপত্র পড়া বা উপন্যাস পড়াও ভুলতে বসেছি। সুতরাং সোশ্যাল ইন্টার?্যাকশন প্যাটার্নটা পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে মাইক্রো লেভেলে, এর একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ড. শাহ্? এহসান বলেন, ‘আমাদের পরিবার বা সমাজের মানুষের সাথে যে সম্পৃক্ততা বা বন্ধন রয়েছে তা পরিবর্তন হওয়ার কারণে আমরা ফেসবুকের নানা তথ্য দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছি। এতে ব্যবহারকারীরা এক ধরনের মানসিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন শ্রেণিপ্রেশার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাদের বিচিত্র জীবনযাত্রা ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের অন্য শ্রেণির কাছে। তখনই এর ব্যবহারকারীরা একে অন্যর সাথে তুলনা করছে। এমন অপ্রাসঙ্গিক চাহিদাই মানসিক চাপ ও উচ্চাভিলাষী চাহিদা তৈরি করছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সি তরুণ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
অপরদিকে, পরিবার থেকে এসব চাহিদা পূরণে অপারগ হলেও ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। ফেসবুকে মানুষের মধ্য একটি গ্রুপিং তৈরি করে দিয়েছে। তুলনার একটি বিষয় তৈরি করে দিয়েছে। ফেসবুকে কে আমাকে লাইক দিলো, কে দিলো না এসব নিয়েও হচ্ছে নানা বিশ্লেষণ। এগুলো থেকেও পারস্পারিক সম্পর্কগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং প্রযুক্তির উপকারিতা থাকলেও বৃহৎ পরিসরে অপকারিতাও রয়েছে। আমাদের সামাজিক সংহতির জায়গাটা দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে আজকাল শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্তার প্রবণতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ফেসবুকেই আমরা সব কমিউনিকেশন করছি। আনন্দের উৎস হিসেবেও ফেসবুককেই ব্যবহার করছি। এর বাইরে আমাদের আনন্দের আর কোনো উৎস নেই, আমাদের ইমোশনের ভেন্টিলেশন বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সদস্যদের সাথে করতে পারছি না। যার কারণে আমাদের মনোজগতটা একটা সাইবার ওয়ার্ড দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এগুলো থেকে মানুষের মাঝে হতাশা ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। আর এ মানসিক চাপের ফলেই সে নিজেকে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে।’
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘যেকোনো আসক্তিই মানুষকে দানবে পরিণত করে তার সত্তাকে পরিবর্তন করে ফেলে। এর ফলে ব্যক্তির মস্তিষ্কের শুভবুদ্ধি বা শুভচিন্তাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। একইরকমভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তিতেও তরুণ থেকে বৃদ্ধ সবাই এ সমস্যার শিকার হচ্ছেন। একজন মানুষের সারা দিনের মোট সময়ের বেশির ভাগ যখন একই কাজে বুঁদ হয়ে থাকে তাকেই আমরা আসক্তি বলি। তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সঠিকভাবে শেষ না করে একটি বিশেষ দিকে ঝুঁকে পড়াই আসক্তির চরম প্রকাশ। এর ফলে তার মস্তিষ্ক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলতে পারে না। ফলে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, পারিবারিক বন্ধন, নিজের যত্ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিও উদাসীন হয়ে পড়ে। আসক্তির চরম মাত্রায় মানুষ ক্রমশ অসামাজিক, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।’
ডা. ইসলাম বলেন, ‘আসক্তি থেকে মুক্তির পথ একটাই— যে জিনিস আমাকে নেশাগ্রস্ত করছে তা পরিহার করা অথবা ওই জিনিস থেকে দূরে থাকা। যদিও আসক্তি থেকে সরে আসা সহজ নয়। কারণ আসক্ত মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক ধরনের হরমোন কাজ করে। আসক্তি থেকে যেহেতু আনন্দ পায় সেহেতু মস্তিষ্কে এই ডোপামিনের মাত্রাও ক্রমেই বাড়তে থাকে। সুতরাং আসক্তি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কৌশলী হতে হবে। একবারেই সব সমস্যা সমাধান না করা গেলেও প্রযুক্তিপণ্যে ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা দিতে হবে। যখন শিডিউল অনুযায়ী আপনার ভার্চুয়াল দুনিয়ায় প্রবেশ করবেন তখন আস্তে আস্তে আপনার নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আসবে। একটি পর্যায়ে এ আসক্তি থেকেও মুক্তি পাবেন। যে সময়টি আসক্ত ব্যক্তি ফেসবুকে থেকে দূরে থাকবেন সে সময় নিশ্চয় কোনো সৃষ্টিশীল কাজে আনন্দ খুঁজে পান তা করতে হবে। এতেও যদি স্বাভাবিক জীবনে আসা না যায় তাহলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।’