গ্রাহক ঠকানোর অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত বছর বন্ধ হয়ে যায় দেশে সাড়া জাগানো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালি। এরপর গ্রাহকের মামলায় গ্রেপ্তার হন প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও চেয়ারম্যান। শত শত কোটি টাকার আত্মসাতের দায়ে থাকা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেয় উচ্চ আদালত।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পর্ষদ। একই সঙ্গে পদত্যাগ করে মূল মালিকের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু করে।
বিদায় বেলায় ই-ভ্যালি নিয়ে দ্বিমুখী বক্তব্য দিয়েছেন বিদায়ী পর্ষদের এমডি ও চেয়ারম্যান। এমডির আশা প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পেলে প্রতিষ্ঠানটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। অন্যদিকে ই-ভ্যালিকে নিয়ে কোনো আশা দেখছেন না সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান। তিনি মনে করেন, প্রতারণায় অভিযুক্ত পরিবারের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারবে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার ই-ভ্যালির অফিসে বিদায়ী পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব কবীর সাংবাদিকদের বলেন, গ্রাহকের টাকা উদ্ধার করার দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়নি। ই-ভ্যালিতে কেন সমস্যা হয়েছে, কতটা সমস্যা হয়েছে, উত্তরণের উপায় কী এসব বিষয়ে যাচাই-বাছাই করতেই আমাদেরকে বলা হয়েছিল। আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছি। ‘আমি বিশ্বাস করি, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পেলে এই প্রতিষ্ঠান আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
তবে আদালত গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এ বিষয়ে একমত নন। তিনি বলেন, গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করার জন্যই রাসেল ই-ভ্যালি নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন। ব্যবসার প্রতিটি স্তরেই তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই পরিবারের নেতৃত্বে এ প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
গত বুধবার আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়ে পদত্যাগ করে আদালত গঠিত পরিচালনা পর্ষদ। এরপর ই-ভ্যালির দায়িত্ব মূল মালিক মোহাম্মদ রাসেলের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। খবর পেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ধানমন্ডিতে কোম্পানির কার্যালয়ের সামনে ভিড় করে শত শত পাওনাদার।
নিজেদের পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ার পাশাপাশি ই-ভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেলের মুক্তির দাবিও জানিয়েছেন তারা। ‘ইভ্যালি মার্চেন্ট অ্যান্ড কনজিউমার কো-অর্ডিনেশন’ কমিটির ব্যানার নিয়ে হাজির হয়েছেন এই পাওনাদাররা। ই-ভ্যালি চালু করার জন্য আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা ব্যানারও ছাপিয়েছেন।
এ সময় ই-ভ্যালি মার্চেন্ট অ্যান্ড কনজিউমার কো-অর্ডিনেশন কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক সাকিব হাসান তাদের পাওনা টাকা উদ্ধারের প্রত্যাশা করছেন। তিনি বলেন, রাসেল পরিবারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করায় আমরা আশাবাদী। ই-ভ্যালি ব্যবসা চালাতে পারলে আমাদের টাকাগুলো ধীরে ধীরে উদ্ধার হয়ে আসবে।
গত বছর বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ই-ভ্যালির পাঠানো সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির মোট চলতি দায় ছিল তখন ৫৪৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে মার্চেন্ট বা পণ্য সরবরাহকারীরা পাবেন ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর গ্রাহকদের পাওনা ৩১১ কোটি টাকা। গ্রাহক ঠকানোর মামলায় ই-ভ্যালির উদ্যোক্তা রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছিল। শামীমা গত এপ্রিল মাসে জামিনে বের হতে পারলেও এখনো বন্দিই আছেন রাসেল।
প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে চেয়ারম্যান করে ই-ভ্যালির জন্য একটি পর্ষদ গঠন করে দিয়েছিল আদালত। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব মিলনকে করা হয়েছিল ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
পর্ষদে সদস্য হিসেবে ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. রেজাউল আহসান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ফখরুদ্দিন আহম্মেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।
মূলত প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত দায়-দেনা, কাজের ধরন ও শত কোটি টাকার বকেয়া থেকে উদ্ধারের পথ বের করার উপায় আছে কি-না, তা দেখাই ছিল এই পর্ষদের উদ্দেশ্য। পর্ষদ তাদের কাজ শেষ করায় এখন আবার মূল মালিকদের কাছেই ফেরত যাচ্ছে ই-ভ্যালি।