নানা সংকটে ঢাকার অচলাবস্থা। রাজধানীতে দিনের বেলায় থাকে না গ্যাস-পানি। গ্যাস সংকটে মধ্যরাতে করতে হয় রান্না। পানির অভাবে দু’-একদিন পরপর সারতে হয় গোসল। রয়েছে বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা, সময়মতো নেয়া হয় না বাসা-বাড়ির আবর্জনা। ওয়াসার পানিতে থাকে ময়লা ও দুর্গন্ধ। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী। আর বস্তির ৩৪ শতাংশ মানুষ ভুগছেন জটিল রোগে।
এদিকে সারা বছর চলে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। হালকা বা ভারী বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। সড়কপথ দেখলে মনে হয় নৌপথ। দীর্ঘদিন তলিয়ে থাকে বহু সড়ক। কারণ খালগুলোর নেই পর্যাপ্ত পানি ধারণ সক্ষমতা ও পানি নিষ্কাশনের জায়গা। ফলে জলাবদ্ধতা যেন নগরবাসীর নিয়তি।
আবার বর্জ্যে ভরপুর এসব জলাধার মশার প্রজননকেন্দ্র। বস্তি, আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক— সবখানেই মিলছে এডিসের লার্ভা। মশা-মাছির জ্বালায় অতিষ্ঠ শিশু থেকে বৃদ্ধ। মশার কামড়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। রাতে মশা, দিনে মাছি এ নিয়ে ঢাকাবাসী। নগরীর গণপরিবহনে নেই শৃঙ্খলা। মানছে না ট্রাফিক আইন, ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। সৃষ্ট যানজটে ভোগান্তির পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা।অর্থের হিসাবে যা প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। সমস্যার মূলে অধিক জনসংখ্যাকে দায়ী করছে দুই সিটি কর্পোরেশন।
আর নগরবিদরা বলছেন, বহুমুখী সমস্যা নিয়ে ঢাকা একরকম অচলাবস্থায় রয়েছে। রাজধানীমুখী জনস্র্রোত কমানোর পরামর্শ তাদের।সম্প্রতি নেয়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সমস্যা সমাধান হবে। তবে এ প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হলেও অস্থায়ী কিছু সমস্যা আছে যা দুই সিটি কর্তৃপক্ষ চাইলেই সমাধান সম্ভব। পাশাপাশি ওয়ার্ডভিত্তিক সমস্যাগুলো নিয়ে সেসব এলাকার নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে কিছু সমস্যা সমাধান করা যায় বলে মনে করেন তারা।
জানা যায়, ঢাকার উচ্চ ঘনত্ব (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৮ হাজার বসবাস)। ঢাকা জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ অবদান রাখছে এবং নগর এলাকার কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ ঢাকায়। ফলে রাজধানীমুখী হচ্ছে মানুষ, এর চাহিদা ও সমস্যা সমাধানে বেগ পেতে হচ্ছে দুই সিটি কর্পোরেশনকে। বর্জ্য ব্যবস্থায় অগ্রগতি থাকলেও এখনো উৎপাদিত পাঁচ হাজার টন বর্জ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ সংগ্রহের বাইরে রয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শহরের বাসিন্দারা।
এদিকে ৩০ শতাংশ মানুষ বস্তি কিংবা অনানুষ্ঠানিক বস্তিতে বাস করে থাকে। অর্থাৎ গৃহ, পানি, বিদ্যুৎসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে তারা।
গবেষণায় দেখা যায়, বস্তির ৩৪ শতাংশ মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। বস্তির ২৭ শতাংশ মানুষ ময়লা পানির জন্য এবং ১৯ শতাংশ জলাবদ্ধতার কারণে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বর্জ্যে ভরপুর খালগুলো মশার প্রজনন কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি সব জায়গায় মিলছে এডিসের লার্ভা।
সর্বশেষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানীর ২৭ ওয়ার্ডে এডিস মশার উপস্থিতি বেশি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৩টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৪টি ওয়ার্ড রয়েছে।
এদিকে বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় ২০২০ সালে যানজটের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বুয়েটের এক হিসাবে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। অর্থের হিসাবে যা প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা।
এদিকে একটি নগরের মধ্যে তিনটি বিষয়ে ভারসাম্য থাকতে হয়— সবুজ এলাকা, কংক্রিট ও সবুজ এলাকা।সবুজ এলাকা থাকতে হবে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। জলাশয় থাকতে হবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আর কংক্রিট এলাকা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। কিন্তু ঢাকা শহরে ৩০ বছর আগের যে পরিমাণ সবুজ এলাকা ছিল, উন্নয়নের কারণে পুরো শহরজুড়েই কংক্রিটে আচ্ছাদিত এলাকা বেড়ে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে সবুজ ও জলাশয় এলাকা। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ফলে এখানে সব ধরনের দূষণ মাত্রাতিরিক্ত। সর্বোপরি বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা।
নগরবিদরা মনে করেন, ঢাকার অচলাবস্থার কারণ হলো সব কিছুর কেন্দ্র ঢাকা এবং পাহাড়সম চাহিদার বিপরীতে সামান্য জোগানের ব্যবস্থা। ৩.২৫ শতাংশ হারে দেশের নগর জনসংখ্যা বাড়ছে। আর ৩৯.৪ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে। যার এক চতুর্থাংশ ঢাকায় বাস করে। ফলে চাহিদার বিপরীতে পরিষেবা দেয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। আবার ঢাকা জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ অবদান রাখছে এবং নগর এলাকার কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ ঢাকায়।
এছাড়া ঢাকার অবকাঠামো ও নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য উপযুক্ত ভূমির অভাব রয়েছে।পাশাপাশি সরকারি জমি দখল ও দূষণ হচ্ছে। নগর উন্নয়নে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার বাস্তবায়ন খুবই কম। তবে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ঢাকা হতে পারে একটি বসবাসযোগ্য শহর। সে জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সক্ষমতা থাকতে হবে। সময়মতো কাজে হাত দিতে হবে, তা না হলে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ওয়ার্ড কেন্দ্রিক নগর ব্যবস্থাপনারও উদ্যোগ নিতে হবে।
সরেজমিন দেখা যায়, গ্যাস-পানি সংকটে নগর জীবন হয়ে উঠেছে অতিষ্ঠ। গ্যাস না থাকায় রাত জেগে গভীর রাতে রান্না করতে হচ্ছে নগরবাসীকে। পাশাপাশি পানি সংকটে নিয়মিত গোসলসহ অন্যান্য কাজে ঘটছে ব্যাঘাত। ওয়াসার যে পানি আসে তাতে থাকে দুর্গন্ধ-ময়লা। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন নগরবাসী। বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক-অলিগলি এমনকি ফ্লাইওভারে পানি জমে থাকছে। খাল দখল ও পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। খালগুলো বর্জ্যে ভরপুর হওয়ায় মশার প্রধান প্রজনন কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
পাশাপাশি সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সেখানে ও সব জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে দিনের বেলায় নগরবাসীকে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। আর শহরে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বর্জ্যের অব্যবস্থাপনায় ময়লা সংগ্রহ পুরোপুরি সম্ভব হয়ে উঠছে না। বাসা-বাড়ি থেকে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা নেয়া হচ্ছে না। ফলে নদীতে বা অন্য কোনো স্থানে ফেলা হচ্ছে গৃহস্থালির আবর্জনা।
এদিকে রাজধানীর অনেক সড়কের ল্যাম্পপোস্ট থাকলেও জ্বলে না বাতি। ফলে ঘটছে নানা চুরি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। দিনের বড় একটি সময় যানজটে কাটছে। এতে করে আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে কয়েকগুণ। এমন হাজারো সমস্যা নিয়ে বসবাস করছেন রাজধানীবাসী।
নগরির বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক সমস্যা আমাদের কয়টি সমস্যার কথা বলব বলেন। নিয়মিত আমরা কর দিচ্ছি, কিন্তু সুবিধা তো পাচ্ছি না। বরং ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। সরকারের উচিত আমাদের জনজীবন স্বাভাবিক করে তুলুক এটিই চাওয়া।
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান আমার সংবাদকে বলেন, ঢাকাকে সচল করতে কিছু অস্থায়ী সমস্যা আছে যা দুই সিটি কর্পোরেশনের সদিচ্ছা থাকলেই সমাধান সম্ভব। যেমন— অবৈধ পার্কিং করতে না দেয়া, ফুটপাত দখলমুক্ত করা। এতে কিছুটা হলেও যান চলাচল স্বাভাবিক হবে এবং নগরবাসীর হাঁটাচলাও সহজ হবে। বর্জ্যের সুশৃৃঙ্খল ব্যবস্থাপনাসহ ছোটখাটো কিছু সমস্যা আছে যা সিটি কর্পোরেশন চাইলেই পারে।
এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটির নতুন যে ১৮টি ওয়ার্ড রয়েছে সেখানে কিন্তু বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলেই তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে করি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় নগরের নানা সংকট নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা আছে। এখন মূল চ্যালেঞ্জ হবে, এ বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার প্রস্তাবনাগুলোকে বিভিন্ন সংস্থার যে প্রকল্প ও উদ্যোগ নেয়ার কথা আছে, এখনই যেন তারা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর এ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে গিয়ে আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের জন্য প্রতি ছয় মাসের মধ্যে ইন্টার ফ্যাক্টরিয়াল মিটিং যেন করে।
পারস্পপরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে যেন উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়। সমস্যা সমাধানের জন্য এটি একটি মাধ্যম হতে পারে। আরেকটা হচ্ছে— ঢাকা নগরের যে সমস্যাগুলো আছে, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সংস্থাগুলোর (ওয়াসা, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন) যার যে দায়িত্ব আছে অর্থাৎ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের প্রতি সে অর্থে নজর দিচ্ছে না। কারণ সংস্থাগুলোর ক্যাপাসিটি অনুযায়ী পারফরম্যান্স দুর্বল। নগরের বর্তমান কাঠামোর মধ্যেও আমরা একটা সুশৃঙ্খল অবস্থা পাবো। তবে এই পুরো প্রক্রিয়াতে কমিউনিটি লেভেলের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা।
অর্থাৎ ওয়ার্ডগুলোকে নাগরিকদের সাথে সম্পৃক্ত করে এলাকাভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি যেসব সমস্যা সহজেই সমাধানযোগ্য তা নিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ করা। বিশেষ করে যেগুলো ব্যবস্থাপনাগত সে উদ্যোগগুলো করা উচিত। যেসব কাজ অবকাঠামোগত সেগুলো আমরা ধীরে ধীরে করতে পারি। কাউন্সিল অফিসগুলো এলাকা ভিত্তিক সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তাহলে অন্তত স্থানীয়ভাবে কিছু সমস্যা সমাধান হতে পারে।