চুক্তি ছিল ৫০ হাজার টাকা। চারদিনের মধ্যেই হত্যামামলার আসামিকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন করাবেন। ঠাকুরগাঁওর একটি হত্যামামলার আসামি জামিল হাসানকে জামিনের জন্য এই দফারফা করেন হাইকোর্টের দুই আইনজীবীর মুহুরি খলিল উদ্দিন ও বেলাল হোসেন। আইনজীবীর ফি বাদে সেই চুক্তি মোতাবেক খলিল ৩৫ হাজার ও বেলাল ৫০ হাজার টাকা নেন।
পরে হত্যা মামলার এজাহার বদলে ও মামলার মেরিট কমিয়ে দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে জামিল হাসানকে জামিনও করান। তবে কিছু দিন পর ঠাকুরগাঁওয়ের আদালতে জামিনের কাগজ গেলে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। নিন্ম আদালতের কাগজপত্র জালিয়াতি করে পাঁচ-সাতটি মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন করিয়েছেন এই মুহুরি চক্র।
গেল বছর আইনজীবীর সহকারী (মুহুরি) হয়েও আইনজীবী পরিচয় দিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতে ভার্চুয়াল জামিন শুনানিতে অংশ নেন আবুল বাশার। এসময় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের সন্দেহ হয়। তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির নেতাদের বিষয়টি জানান। ঢাকা আইনজীবী সমিতির নেতারা তাকে আটক করেন। এরপর ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদার তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালতে মুহুরিদের অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। ভুয়া মামলা, জামিন ও আইনজীবী সেজে বিচারপ্রার্থীদের সাথে প্রতারণা নিত্যদিনের ঘটনা।
আদালতে মুহুরিদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এক প্রকার মুহুরিনির্ভর হয়ে পড়েছে আদালতপাড়া। মামলা রজু, জামিনাদেশ, সাক্ষী হাজিরা, নিষেধাজ্ঞা, শুনানি, মামলাসংক্রান্ত কোনো কাজেই যেন আইনজীবীর দরকার নেই। মক্কেলরা আদালতে এলেই দেন নানা আইনি পরামর্শ। দ্রুত বিচার শেষ করে দেবেন, মেলে এমন প্রতিশ্রুতিও। ফাইলিং ও মামলার খরচ নিয়েও মক্কেলদের রফাদফা করেন মুহুরিরা। মাঝে মধ্যে আইনজীবী সেজে আদালতে শুনানিতেও দাঁড়ান।
মামলাও লিখেন, আরজি, দরখাস্ত নিজেই লিখেন। তবে প্রতিটি মামলার ড্রাফটিংয়ে যেন ভুলের শেষ নেই। এতে শুনানিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন আইনজীবীরা। মুহুরিদের লেখা আরজি বিচারকদের ঠিকমতো বোঝাতেও পারেন না আইনজীবীরা। এদিকে আইন না জেনেও মুহুরি দিয়ে মামলা লিখার মতো বেআইন কাজ করায় বেশির ভাগ মামলায় বিচারে হারছেন বিচারপ্রার্থীরা। অথনৈকিতভাবেও হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ বার কাউন্সিল আদেশ ১৯৭২ অনুসারে আইনজীবী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির মামলা দায়ের-পরিচালনা করার সুযোগ নেই।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো মুহুরিরাই মক্কেলের কাছ থেকে প্রধানত মামলা গ্রহণ করে চলেছেন। জানা গেছে, মুহুরিদের লেখা আরজি, দরখাস্ত্ত না পড়েই স্বাক্ষর করে শুনানিতে আসেন আইনজীবীরা। বিচারক মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সঠিক জবাব দিতে পারেন না আইনজীবীরা, বিচারক জানতে চাইলেই বলেন, মুহুরি জানে। মুহুরিরা একেক দিন একেক আইনজীবী হাজিরা দিচ্ছেন। কোনো ওকালতনামাও দিচ্ছেন না। ধরা পড়লে বলছেন— আইনজীবী অসুস্থ থাকায় বা অনুপস্থিত থাকায় তার পক্ষে হাজিরা দিয়েছি।
আইনজ্ঞরা বলছেন, ভুলে ভরা মামলা বা জামিনাদেশ বিচারক খারিজ করলে দিন শেষে বিচারপ্রার্থীর ক্ষতি। অথচ আইনজীবী নিজে মনিটরিং করলে এরকম হওয়ার কথা নয়। এর ফলে মামলার বিচারে অস্বাভাবিক সময় লাগছে। এরকম আরো অনেক সমস্যা আছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের পক্ষে আইনানুগ লড়াই করতে চাওয়া বিজ্ঞ আইনজীবীদের এ ব্যাপারে করার আছে অনেক কিছু।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, ‘মামলার সর্বশেষ ও তাৎক্ষণিক অবস্থা, তারিখ, এজলাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীকে অবহিত করা, মামলার রায় ও আদেশের অনুলিপিসহ বিভিন্ন নথি আদালতের বিভিন্ন দপ্তর থেকে সংগ্রহ করা মুহুরিদের কাজ। মুহুরি হলো আইনজীবীর কর্মচারী (সহকারী)। মুহুরিদের মামলা পরিচালনার আইনগত সুযোগ নেই। মক্কেল ও আইনজীবীদের মুহুরিদের কাছে মামলা হস্তান্তর থেকে বিরত থাকা উচিত।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘আপনাকে বুঝতে হবে— মহুিরকে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেন শুধুমাত্র তার নির্ধারিত মামলায় অফিসিয়াল কাজে সহযোগিতা করার জন্য। এ ক্ষেত্রে তার কাজের পরিধি হলো নির্দিষ্ট মামলার তারিখ আপডেট করা, মামলার ফাইলপত্র এগিয়ে নেয়া ইত্যাদি। কোনো মুহুরি নিজে কোনো মামলা গ্রহণ বা পরিচালনা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেন না, কোনো ব্যক্তি ডাক্তারি না পড়ে অপারেশন করতে গেলে যেমন রোগী মারা যাবে, ঠিক তেমনি মুহুরি দিয়ে আইনি কাজ পরিচালনা করলে আপনার মামলায় আপনি চরমভাবে পরাজিত হবেন এবং এটি ন্যায়বিচারের অন্তরায় বলে বিবেচিত।’