বড় শঙ্কায় রপ্তানি খাত

জাহিদুল ইসলাম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২, ০১:৩৭ এএম
বড় শঙ্কায় রপ্তানি খাত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চরম আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছে করোনাপরবর্তী পৃথিবী। আগামী দিনগুলোতে বিশ্বকে ভয়াবহ আর্থিক মন্দায় পড়তে হবে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ রপ্তানি আয় বাড়িয়ে রিজার্ভের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে চাইছে। তবে সংকটের মধ্যেই রপ্তানিতে নানামুখী বাধার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মূল শক্তি তৈরি পোশাক খাত মূলত ইউরোপের দেশগুলোর ওপর অধিক নির্ভরশীল।

কিন্তু যুদ্ধ প্রেক্ষাপটে একের পর এক অর্ডার বাতিল করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। অনেকে শিপমেন্ট বিলম্ব করার অনুরোধ করছে। ভাটা পড়েছে রপ্তানি আদেশে। এমন অস্থিরতার মধ্যেই পোশাক খাতের প্রধান কাঁচামাল তুলার মজুত সংকট তৈরি হওয়ায় রপ্তানি খাতে বড় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর ফলে বিশ্লেষকরা আগামীর দিনগুলোতে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত থেকে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাত থেকে ৪৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি আয় হয়। আর এই পোশাক খাতের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানিতে সে সময় ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার। আমাদের দেশে প্রতি বছর তুলার চাহিদা থাকে গড়ে ৭৫ লাখ বেল (প্রতি বেল ১৮২.২৫ কেজি)।

তবে করোনা-পরবর্তী ২০২১ সালে চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৮৫ লাখ বেল। তবে তৈরি পোশাক খাতের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো অন্য দেশ থেকে অর্ডার ফিরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে দেয়ায় চলতি বছর এই চাহিদা আরো বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ইউএস অ্যাগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্ট-ইউএসডিএ।

সংস্থাটির ধারণা, চলতি বছরে এই চাহিদা ৮৮ লাখ ১০ হাজার বেলে পৌঁছবে, যা আগের বছরের চেয়ে ৩.৫২ শতাংশ বেশি। টেক্সটাইল শিল্পের সাথে জড়িতরা জানান, সাধারণত চার থেকে পাঁচ মাসের কাঁচামাল মজুত থাকতে হয়। সে ক্ষেত্রে দেশে এই মুহূর্তে মাত্র এক মাসের কাঁচামাল মজুত আছে। এই মজুত কাঁচামাল দিয়ে তিন মাসের উৎপাদন কার্যক্রম চালানো যাবে। এ ক্ষেত্রে পোশাক রপ্তানিকারকদের সময়মতো সূতা ও কাপড় সরবরাহ করতে না পারলে আরএমজি খাত সমস্যায় পড়বে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, তেমনটি হলে বায়াররা হয় অর্ডার বাতিল করবে, নয়তো ক্ষতিপূরণ হিসেবে মূল্যছাড় চাইবে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গার্মেন্টস শিল্পের জন্য যে কাপড় দরকার হয় তা আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে দেশেই উৎপাদন করা হয়। তবে কাপড় উৎপাদনে যে তুলার প্রয়োজন হয়, তার ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত ভারত, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও আফ্রিকার দেশুগলো থেকে আমদানি করা হয়। দেশে মাত্র এক লাখ ৭৬ হাজার বেল তুলা উৎপাদন হয়। অর্থাৎ বেশির ভাগ তুলাই আমদানি করতে হয়। ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী তুলা মজুত না থাকায় এবং ডলার সংকটের অজুহাতে ব্যাংকগুলো নতুন করে এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করায় সময়মতো আমদানি করা যাবে না পোশাক খাতের এই কাঁচামাল। তা ছাড়া এমনিতেই গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে পোশাক কারখানাগুলোতে। ডিজেলে উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রাখায় বেড়ে গেছে ব্যয়। কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে এই বাড়তি অর্থ নিতে না পারলে অনেক গার্মেন্টসই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর ঢাকা অঞ্চলের এক পরিচালক দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘গ্যাসের চাপ কম থাকায় এখন আমাদের ব্যাকআপ হিসেবে তেল (ডিজেল) দিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে কোটি কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে চাচ্ছে না, এটি সঠিক তথ্য নয়। হয়তো দু’-একজনের জন্য হতে পারে, কিন্তু সবার জন্য নয়। কারণ এলসি না খুললে ব্যাক টু ব্যাক ডলার আসবে না। অনেক বায়ার চায়না থেকে সরে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার দেশগুলো সুইস করছে, এটি সঠিক। তারপরও বর্তমানে যুদ্ধের কারণে ইনফ্লেশন যে অবস্থায় গেছে, আমি বলব এই মুহূর্তে বিজনেস সিচুয়েশন ইজ নট পজিটিভ।’

পোশাক খাতের ওপর নানামুখী সংকট সহসাই কাটবে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সহসাই কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। তবে আমাদের চেষ্টা চলছে উতরে আসার। নতুন নতুন প্রোডাক্টের দিকে যাচ্ছি। একটা সময় কটনের বাইরে গিয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কাজ করতাম। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কটনের চাহিদা ২৫ শতাংশ। ফলে আমরা ম্যানমেইড ফাইবারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যখন প্রোডাক্ট ডাইভারসিফিকেশন বাড়বে তখন আমাদের মার্কেট আরো বড় হবে। তখন এর একটা প্রভাব পড়বে, তবে তা এত দ্রুত নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু সবাই ভুক্তভোগী, তাই যতক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ না হবে, ইউরোপ-রাশিয়ার পরিস্থিতি ঠিক না হবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই বলতে পারবে না, পরিস্থিতি কোনো দিকে গড়াবে। এমনিতেই আগস্ট-সেপ্টেম্বরে গার্মেন্টস একটু ডিপ থাকে, বিশেষ করে ওভেনে। এখন সেই ফেজটাই এখন পার করছি। তবে এর সাথে সব কিছু মিলে প্রভাবটা আরো বেশি পড়ছে।’

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের তুলা আমদানি পুরোটাই বেসরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন। এর মধ্যে কিছু আমদানি করে স্পিনিং মিলগুলো, আবার কিছু আছে ট্রেডার। তারা শুধু তুলা আমদানি করে স্পিনার্সদের কাছে বিক্রি করে। তবে চলতি বছরে আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতা পুরো বিশ্বেই হয়েছে। যেমন, ব্রাজিল-ইউএসএতে খরার প্রভাব, পাকিস্তানে বন্যা, আফ্রিকার একটি বড় অংশে খরার ধাক্কা, ভারতে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় কোনো কোনো অঞ্চলে তুলা চাষ ভালো হয়েছে, আবার কোনো কোনো অঞ্চলে তুলার পরিবর্তে সয়াবিনের চাষ হচ্ছে। ফলে পুরো বিশ্বেই একটা অস্থিরতা যেমন অর্থনৈতিক দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তেমন হয়েছে আবহাওয়ার দিক থেকে। পাশাপাশি কনটেইনার এবং জাহাজভিত্তিক সরবরাহ ব্যবস্থা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব কিছুটা পড়ছে। তবে আমাদের দেশের তুলাগুলো নভেম্বরের শেষের দিকে আসা শুরু করবে। তখন হয়তো কিছু সামাল দেয়া যাবে।তুলার মজুত সংকট তৈরি হওয়ায় হুমকিতে পড়েছে প্রধান রপ্তানি খাত। এই দায় কার? এমনটি জানতে চাওয়া হয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বস্ত্র) মো. আবুল কালাম আজাদ, এনডিসির কাছে।

তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘যদি তুলা সংকট হতো তাহলে তো আমরা জানতাম। গতকালও (রোববার) আমাদের বস্ত্র দিবস নিয়ে প্রস্তুতি সভা হয়েছে অংশীজনদের সাথে। কিন্তু কেউ তো এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি। তাই এই বিষয়ে খোঁজ না নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে অফিসিয়ালি আমরা এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ পাইনি যে, তুলা আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে।’

এদিকে তুলার ওপর ভবিষ্যতে আমদানিনির্ভরতা কাটাতে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, এমন জানতে চাওয়া হয় তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মো. আখতারুজ্জামানের কাছে। তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের জমি সংকট থাকায় অল্প জমিতে যেন অধিক ফসল ফলাতে পারি সে জন্য গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা হাইব্রিড তুলা চাষ করছি। আমরা টার্গেট নিয়েছি প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত যেন ১৫ মণ পর্যন্ত চাষিরা ফলন পায়। এছাড়া আমরা হিল ট্র্যাক্ট, বরেন্দ্র এলাকা, চর এলাকা, নতুন সৃজনকৃত ফলের বাগানের মধ্যে এবং তামাকের পরিবর্তে তুলা চাষের পরিকল্পনা নিয়েছি। আমরা আশা করছি এবার হয়তো দুই লাখ বেলের উপরে তুলা উৎপাদন করতে পারব। আবার আমাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক সুগারমিলের জমি রয়েছে। স্পিনিং মিলগুলোর উদ্যোগে যদি এসব জমি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ব্যবস্থায় কৃষকদের দেয়া হয় তবে উৎপাদন চাহিদার ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তুলা উন্নয়ন বোর্ড থেকেও স্পিনিং মিলগুলোকে কারিগরি সহায়তা করা হবে। তা ছাড়া তুলার পাশাপাশি যেন অন্যান্য সবজি চাষ করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এতে প্রতি কেজি তুলা আমদানিতে যে তিন ডলার খরচ হয়, তা বেঁচে যাবে। ফলে যেমনিভাবে স্পিনিং মিলাররা লাভবান হবে, তেমনি চাষিরাও উপকৃত হবেন। আমরা যদি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তৈরি করতে পারি যেমন— তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড়, কাপড় থেকে গার্মেন্টস। এতে সার্বিকভাবে দেশ লাভবান হবে। এখানে সবার, বিশেষ করে বেসরকারি খাতের মনোযোগ দেয়া দরকার।’