আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস

গতি ফিরছে পর্যটনশিল্পে

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২, ০৯:৪৫ এএম
গতি ফিরছে পর্যটনশিল্পে

আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস। প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালন করা হয়। ‘রিথিংকিং ট্যুরিজম’ বা পর্যটনে নতুন ভাবনা প্রতিপাদ্যে এ বছর সারা বিশ্বে এ দিনটি পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের অধীনস্থ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে সব সদস্য দেশে এটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় ও পর্যটন কেন্দ্রের সাথে সেতুবন্ধন গড়ে তোলা।

এছাড়াও, পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া এ দিবসের অন্যতম লক্ষ্য।করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশে আসতে ইচ্ছুক বিদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ ছিল।

তবে গতকাল সোমবার থেকে বিদেশি পর্যটক আসার বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। একই সাথে দিবসটি পালন উপলক্ষে পর্যটন ভবন থেকে বর্ণাঢ্য র?্যালি আয়োজন ছাড়াও পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল, মোটেলগুলোতে রাত্রীযাপনের ওপর ৩০ শতাংশ ডিসকাউন্ট থাকবে। সকাল ৭টা থেকেই পর্যটন ভবনের নিচতলার উন্মুক্ত স্থান ও সম্মুখে রাস্তার আইল্যান্ডে খাবারের স্টলগুলোতে সংস্থার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় পরিবেশিত খাবারের বৈচিত্র্যময় রেসিপি ও দেশের ঐতিহ্যবাহী নানা রকম খাবার, পানীয় ও পিঠা-পায়েস ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেন্যুও এতে উপস্থাপিত হবে। এই খাদ্য উৎসবটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং খাবারগুলো স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করা হবে।

আরও থাকবে লাইভ কুকিং শো। বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। তাদের ৭৫ শতাংশ এখন ভ্রমণ করেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও সারা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন মার্কেটের অন্যতম। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৪ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এ খাতে গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বাড়ার সম্ভাবনা আছে। সে হিসাবে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটনশিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরের যেমন— পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগব্যবস্থা থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য কোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি।

দেশে দেশে পর্যটনশিল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন শিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে শুধু কিছু হোটেল-মোটেল নির্মাণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। পর্যটকদের যাতায়াত, নিরাপত্তা, থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ সব কিছুর সুবন্দোবস্ত থাকা আবশ্যক। শহর, নগরগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে।

তাহলেই কেবল পর্যটন খাতে ভালো ভবিষ্যতে আশা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় যাতায়াত ব্যবস্থার সুবন্দোবস্ত না থাকায় এ সৈকতে এখনো কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায় পর্যটকের আনাগোনা নেই। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা বেশি বলে অনেকে বলে থাকেন। এখানে বেড়াতে এসে অনেকে দুর্বৃত্তের কবলে পড়েন। কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে গোসলে গিয়ে অনেকে বিপদে পড়েন ও প্রাণ হারান। কাজেই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। যে সব স্থানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। একই সাথে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে পর্যটনশিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। পর্যটনশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সব পক্ষকে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটনশিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে।

দেশের পর্যটন খাতের সম্ভবনা নিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বর্তমান সরকার পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। পর্যটনশিল্পে করোনার কারণে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ও টেকসই পর্যটন উন্নয়ন নিশ্চিতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, করোনার প্রভাবে দেশের পর্যটন শিল্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সংকট থেকে উত্তরণের উপায় ও ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক পর্যটন বাজারে সুবিধা অর্জনের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ইতোমধ্যে একটি ‘ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান’ নিয়েছে। এই পরিকল্পনায় উল্লিখিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০টি গাইডলাইন প্রস্তুত করেছে ও সেই অনুযায়ী কাজ করছে। যার ফলে ইতোমধ্যে পর্যটনশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ফলে গতি ফিরছে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পে।

যেভাবে এসেছে পর্যটন দিবস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমপ্রসারণের ফলে বিশ্বব্যাপী পর্যটন ব্যবসার প্রসার ঘটে। এ অবস্থায় পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও ভোক্তা শ্রেণির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ভ্রমণবিষয়ক সংস্থা বা আইইউওটিও।

এ সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজস্ব আয়ে বিশেষ অবদান রাখার প্রেক্ষিতে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানরূপে যুক্ত হয়। সংস্থাটির কার্যক্রম আরো জোরদার করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের বাৎসরিক সম্মেলনের সময় এই সংস্থার সদস্যভূক্ত দেশগুলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে করণীয় ঠিক করার মাধ্যমে বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছিল।

১৯৭০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সংস্থাটির বার্ষিক সম্মেলনে এর নাম, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য পুণর্মূল্যায়ন ও নির্ধারণ করা হয় এবং তখন থেকে এটি ‘বিশ্ব পর্যটন সংস্থা’ নামে চিহ্নিত করার বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যার কার্যক্রম নতুন নামে ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু হয়।

১৯৮০ সালের বার্ষিক সম্মেলনে, এই সংস্থার গঠনের দিবসে অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পর্যটন দিবস পালনের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে তুরস্কে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে এতে একটি স্বাগতিক দেশ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালনের কার্যক্রমে আরো গতিশীলতা আনয়ণের পক্ষে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।