চতুর্থ শিল্প বিল্পবের অভিযাত্রায় বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নয়নের কাণ্ডারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন আজ। পিতা মুজিব এনেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা, আর তিনি কঠিনতম পথ পাড়ি দিয়ে এনেছেন বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি। তাকে বলা হয় আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা। ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, জাতির পিতার রক্ত, স্বপ্ন, দ্রোহ আর বেদনা বুকে ধারণ করে হয়েছেন বাঙালির বিশ্বজয়ের স্বপ্নসারথি। সততা, সাহসিকতা ও মানবতার রাজনীতিতে স্বীকৃতি পেয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানের।
জাতির পিতা দুটি স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। একটি হলো স্বাধীন মাটি আরেকটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। পিতা মুজিবের কালজয়ী নেতৃত্বে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পরাধীনতা ভেদ করে স্বাধীন পতাকা নিয়ে যখনই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে একজন মুজিব নিরন্তন ছুটে চলতে শুরু করলেন, ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আর এদেশীয় দোসরদের নির্মমতার বলি হন জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বিশ্বাসঘাতকদের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
স্বাধীনতার ৫১ বছরে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। তার জ্যৈষ্ঠ কন্যার নেতৃত্বে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। পিতার রক্তের পরশ মেখে আজ বিশ্বের বুকে জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি উন্নয়নশীল, মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে। করোনা মহামারিতে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো যখন বিপর্যস্ত তখন শেখ হাসিনার সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপে বিশ্ববাসীর প্রশংসা পেয়েছে বাংলাদেশ।
আশঙ্কা করা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মারা যাবে। কিন্তু সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের কারণে গত এক বছরে একজন মানুষও অনাহারে মারা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারা দেশে আ.লীগের নেতাকর্মীরা সবসময় মানুষের পাশে ছিলেন, যার ফলে সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। করোনার মোকাবিলায় সরকারপ্রধান হিসেবে সফলতা কুড়িয়েছেন তিনি। করোনার সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জাতিসংঘ (ইউএন), বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডাব্লিউইএফ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে।
বিশ্লেকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এশিয়ার প্রায় সব দেশের উপর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্ব, সময়োচিত পদক্ষেপ, মানুষের জন্য আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা, অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রণোদনা ঘোষণা এবং বাস্তবায়নের কারণে দেশে অনাহারে একজন মানুষেরও মৃত্যু হয়নি, খাদ্যের জন্য কখনো কোথাও হাহাকার হয়নি। বিনামূল্যে নাগরিকদের করোনার টিকা প্রদান করেও প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে আসতে যেমন বারবার হোঁচট খেয়েছে, ঠিক তেমনটি শেখ হাসিনাও অগ্রযাত্রার সেনাপতি হিসেবে বারবার কঠিনতম পথ ডিঙিয়ে এসেছেন।
১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যখন কালো অন্ধকারে ঢাকা পুরো বাংলাদেশ, জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয়া নেতৃত্বদানকারীরা কেউ মৃত, কেউ কারাগারে অথবা কেউ বিভ্রান্ত— ঠিক তখনই ১৯৮১ সালে কালো অন্ধকারে ছেয়ে থাকা দেশকে আলো দেখাতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হাজির হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শত্রুর তাক করা বন্দুক উপেক্ষা করে নামেন বাঙালির ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। দেশের মানুষের মুক্তির স্বপ্নের মূর্ত প্রতীক হয়ে ঘুমন্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত জাতিকে আবার স্বপ্ন দেখাতে চষে বেড়ান সারা দেশ। দীর্ঘ ২১ বছরের লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে, উন্নত-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে হয়ে উঠেন অক্লান্ত-নির্ভীক সৈনিক।
বঙ্গবন্ধুকন্যার লড়াই-সংগ্রামের দুর্বিষহ জীবনের কথা স্মরণ করে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব না জন্ম নিলে আমরা যেমন দেশ পেতাম না, পতাকা পেতাম না, জাতীয় সঙ্গীত পেতাম না, মানচিত্র পেতাম না, তেমনই জননেত্রী শেখ হাসিনা জন্ম না নিলে গণতন্ত্র পেতাম না, সামাজিক ন্যায়বিচার পেতাম না, অর্থনৈতিক মুক্তিও পেতাম না, ভোট ও ভাতের অধিকার পেতাম না, একটি মর্যাদাশীল দেশও পেতাম না।’
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধুমতি নদীবিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। পাঁচ ভাইবোন। কনিষ্ঠদের মধ্যে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেল। তিনি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। শৈশব-কৈশোর কেটেছে দাদা-দাদির কোলে-পিঠে, বাইগার নদীর তীরে। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান জেল-জুলুম, রাজরোষ ছিল তার নিত্য সহচর। রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সংগঠন নিয়েই শেখ মুজিবুর রহমানের দিন-রাত্রি, যাপিত জীবন।
এ কারণে পুত্র-কন্যারা পিতার সান্নিধ্য পেয়েছে খুবই কম। যার কারণে বাবার দেখা পেতেন কদাচিৎ। শৈশব-কৈশোরে পিতা মুজিবের স্নেহ-ভালোবাসা না পেলেও বাবার বিশালত্ব ছুঁয়েছেন। শত হুমকি ধমকি, বিশ্ব মোড়লের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই পিতা মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন। শক্ত হাতে হাল ধরেছেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের।
চতুর্থবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে রেখে চলেছেন হিমাদ্রি শিখর সফলতার ছাপ। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমন, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গঠন ও মানবতায় বিশ্বের মোড়লদের মধ্য আলোকবর্তিকা হয়েছেন। যার আলোয় আজ গোটা বাংলাদেশ বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদারমুক্ত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের একমাত্র কারিগর শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন করা, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি এবং সমুদ্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করা, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৪ বছর চার মাসে উন্নীত, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫.৬০ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারী নীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফাইভ-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো এবং ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে উন্নয়নে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে বাংলাদেশ। বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলে বাংলাদেশ হবে আধুনিক রাষ্ট্র। পিতা মুজিবের আদর্শে স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করার দুর্গম পথের অভিযাত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমরা যেমন বলি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, তেমনই শেখ হাসিনার জন্ম না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ জাতি চোখে দেখত না। শেখ হাসিনার জন্মের সফলতা ও সার্থকতা কর্মের মধ্য দিয়ে।
একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যার অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্যবিমোচন, উন্নয়ন এবং দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ অসংখ্য পদকে, পুরস্কার আর স্বীকৃতিও পেয়েছেন। মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে আশ্রয়হীন ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। জাতিসংঘের ২০১৮ সালের অধিবেশন এবং ২০১৯ সালের অধিবেশনে বিশ্ব নেতারা তার এই মানবিক দৃষ্টান্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে। সাহসী, বিচক্ষণ, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থা দ্য স্ট্যাটিসটিকস শেখ হাসিনাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। প্রধানমন্ত্রী এবারও তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গত ২৪ সেপ্টেম্বর অন্যান্য বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে ইউএনজিএর সাধারণ আলোচনায় অন্যান্য বছরের মতো বাংলায় ভাষণ দেন।
গত বছর ৭৬তম অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশন্স নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) দারিদ্র্য দূরীকরণ, পৃথিবীর সুরক্ষা এবং সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সর্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সঠিক পথে অগ্রসরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাই জাপানের ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৭ সালের ২৫ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের ডান্ডি অ্যাবার্বেত বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টর অব লিবারেল আর্টস’ ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৭ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শান্তি, গণতন্ত্র ও সৌহার্দ্য স্থাপনে অনন্য ভূমিকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘নেতাজী মেমোরিয়াল পদক’ দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক রোটারি ফাউন্ডেশন ‘পল হ্যারিস ফেলো’ নির্বাচিত করে।
একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের লায়ন্স ক্লাবসমূহের আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক ‘রাষ্ট্রপ্রধান পদক’-এ ভূষিত হন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ইউনেস্কো শেখ হাসিনাকে ১৯৯৮ সালে ‘ফেলিক্স হোফে বোইনি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী আয়োজিত এক বিশেষ সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৮ সালের ১২ এপ্রিল শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য নিখিল ভারত শান্তি পরিষদ ‘মাদার তেরেসা’ পদক প্রদান করে। ১৯৯৮ সালে নরওয়েতে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধী ফাউন্ডেশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এম কে গান্ধী’ পদক প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানস্বরূপ জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) কর্তৃক ‘সেরেস পদক’ লাভ করেন। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের জন্য অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৯ সালের ২০ অক্টোবর সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ উপাধি দেয়। যুক্তরাজ্যের ব্রিজপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব হিউমেন লেটার্স’ প্রদান করে।
২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে। ২০০০ সালে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকন উইমেন্স কলেজ ‘পার্ল এস বাক’ পদক প্রদান করে। ২০০০ সালে আফ্রো-এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফেডারেশন ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত করে।
২০০৫ সালের জুন মাসে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শান্তির পক্ষে অবদানের জন্য রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডস ইউনিভার্সিটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক-২০০৯’-এ ভূষিত হন। ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অবদানের জন্য সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় ‘অনারারি ডক্টরেট’ ডিগ্রি প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ২০১০ সালে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় জাতিসংঘ ‘এমডিজি পুরস্কার’ প্রদান করে। ২০১১ সালে প্যারিসের ডাউফিন ইউনিভার্সিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মর্যাদাপূর্ণ স্বর্ণপদক ও ডিপ্লোমা পুরস্কার প্রদান করে। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ), সাউথ-সাউথ নিউজ ও জাতিসংঘের আফ্রিকা সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কমিশন যৌথভাবে স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনের জন্য সাউথ-সাউথ পুরস্কার প্রদান করে। ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দূরদর্শী নেতৃত্ব, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের স্পিকার জন বারকো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গ্লোবাল ডাইভারসিটি অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেন। ২০১২ সালে ত্রিপুরা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১২ সালে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো ‘কালচারাল ডাইভারসিটি পদক’ প্রদান করে। ২০১২ সালে বন ব্যবস্থাপনায় সাফল্যের জন্য ইকুয়েটর পুরস্কার, ওয়াঙ্গারি মাথাই পুরস্কার এবং আর্থ কেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন।
২০১৩ সালের ১৬ জুন দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূরীকরণে অবদানের জন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্যবিমোচনে অবদানের জন্য ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড-২০১৩’ পুরস্কার প্রদান করে। ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের জন্য ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় সাউথ এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক ম্যানহাটন অ্যাওয়ার্ড-২০১৩ লাভ করেন।
২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে অবদানের জন্য ইউনেস্কো ‘শান্তি বৃক্ষ পুরস্কার’ প্রদান করে। ২০১৪ সালে ডিজিটাল ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অগ্রগতি ও শিক্ষার প্রসারে অবদানের জন্য ‘সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আইসিটির ব্যবহারে প্রচারণার জন্য শেখ হাসিনাকে ‘আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। দেশের উন্নয়নে তার অব্যাহত অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে এ পদক প্রদান করা হয়।
২০১৫ সালে শেখ হাসিনা পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ বৈশ্বিক পুরস্কার চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দূরদর্শী পদক্ষেপ নেয়ায় তাকে সেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০১৬ সালে শেখ হাসিনাকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার ও ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ দেয়া হয়। নারী ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। উইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) ও ইউনেস্কো বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীকে ‘ডব্লিউআইপি গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয়।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য তাকে এ পদক দেয়া হয়। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ বার্লিনে নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখায় ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান উইমেন ‘লাইফ টাইম কন্ট্রিবিউশন ফর উইমেন্ট এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করে।
২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য অসামান্য অবদান, জনকল্যাণ বিশেষত নারী ও শিশুদের কল্যাণে বিশেষ অবদান রাখা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্য শেখ হাসিনাকে ভারতের ‘ড. কামাল স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০১৯’ প্রদান করে।
২০১৯ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে সমন্বিত টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যাপক সফলতার জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই গ্যাভি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করে। ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল-ইউনিসেফ তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘চ্যাম্পিয়ন ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ সম্মাননায় ভূষিত করে। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি ‘ঠাকুর শান্তি পুরস্কার-২০১৮’ প্রদান করে। শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গীপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হওয়ার পর তার পরিবারকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। তিনি পুরনো ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে বসবাস শুরু করেন। পরে তিনি যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হন। আবাস স্থানান্তরিত হয় ৩ নম্বর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনা ভর্তি হন টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
এসময় তিনি ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকার বকশী বাজারের পূর্বতন ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজছাত্রী সংসদের সহ-সভানেত্রী (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন। সে বছরই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় কিশোরী বয়স থেকেই তার রাজনীতিতে পদচারণা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ছয় দফা দাবিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এক অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। শাসকগোষ্ঠী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। শুরু হয় প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন। আটক থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তার জীবন ও পরিবারের ওপর নেমে আসে গভীর শঙ্কা ও দুঃষহ দুঃখ-কষ্ট। এই ঝড়ো দিনগুলোতেই কারাবন্দি পিতা বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে শেখ হাসিনার বিয়ে হয় ১৯৬৮ সালে। বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় ১১ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেত্রী হিসেবে তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
এসময় বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন। জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ডাক আসে দেশ-মাতৃকার হাল ধরার। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জেল-জুলুম, অত্যাচার কোনো কিছুই তাকে তার পথ থেকে টলাতে পারেনি এক বিন্দু। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে গতি পায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল। রাজধানীসহ প্রতিটি গ্রামে গ্রামে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের পতাকা উত্তোলিত হতে থাকে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে যা প্রথমবারের মতো সফলতা পায়।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। একজন শেখ হাসিনার আকাশ ছোঁয়া সফলতার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে জীবনাবসানের ঝুঁকি ছিল। ঈর্ষণীয় নেতৃত্ব আর সফলতার জন্য প্রতিপক্ষের আঘাত বারবারই তার ওপর এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারাভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বারবার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে তার লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল।
১৫ আগস্টের পর অন্তত ১৯ বার আঘাত এসেছে তার জীবনের ওপর। প্রতিবার তিনি বেঁচে গেলেও একাধিক ঘটনায় জীবন দিতে হয়েছে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে দলীয় সমাবেশে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে সাতজন নিহত এবং তিন শতাধিক লোক আহত হয়। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্টও হামলার শিকার হন তিনি। ওইদিন রাতে বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টির একদল সন্ত্রাসী ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ১৯৯১-এর ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে ধানমন্ডির একটি স্কুলে উপনির্বাচনের ভোট দেয়ার পর তাকে লক্ষ্য করে ২০-২৫ রাউন্ড গুলি ও বোমাবর্ষণ করে সন্ত্রাসীরা।
এরপর ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদীতে রেলগাড়িতে সফরে ছিলেন শেখ হাসিনা। নাটোর স্টেশনে তার সমাবেশে যোগদানের কথা ছিল। ওই সমাবেশ পণ্ড করতে দুর্বৃত্তরা বোমা হামলা চালায়। ওই হামলার টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের কাছে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় গুলিবর্ষণ করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি), ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলের কাছে এবং হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিল। পরে বোমা রাখার বিষয়টি গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে, আর বেঁচে চান শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের ২৯ মে হামলার শিকার হন সিলেটে। ২০০২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায়।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল আবারো হামলার শিকার হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার শিকার হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারি মদতে পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা চালানো হয়; শেখ হাসিনাকে হত্যা করাই ছিল মূল লক্ষ্য। গুরুতরভাবে আহত হলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
তবে এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান অসংখ্য নেতাকর্মী। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনের অবসান হলেও বিএনপির রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করেন। হাওয়া ভবনের নির্দেশে চলতে থাকে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নির্বাচনি প্রহসনের প্রস্তুতি। গর্জে উঠে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। শুরু হয় গণআন্দোলন। বাতিল হয় পাতানো নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন ইয়াজউদ্দিন। ঘোষিত হয় জরুরি অবস্থা। ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এক-এগারোর পর নতুন ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য হাজির করা হয় ‘মাইনাস টু’ তত্ত্বের। শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে আসার সময় নিষেধাজ্ঞা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সাহসী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারি নিষেধাজ্ঞা, ষড়যন্ত্র ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে ফিরে আসেন প্রিয় স্বদেশে। কিন্তু এর মাত্র দুই মাস পর ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে শেখ হাসিনাকে দানবীয় কায়দায় গ্রেপ্তার করা হয়।
জাতীয় সংসদ এলাকায় একটি অস্থায়ী কারাগারে তাকে বন্দি করে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক মিথ্যা মামলা। কারাগারে তার জীবননাশের ষড়যন্ত্র চলে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে চলতে থাকে গণসংগ্রাম ও আইনি লড়াই। আওয়াজ ওঠে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন নয়। বদলে যায় দৃশ্যপট। জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অর্জিত হয় ঐতিহাসিক বিজয়। এককভাবে আওয়ামী লীগই লাভ করে তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। গঠিত হয় মহাজোট সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যনে টানা তৃতীয় এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ৭৬তম জন্মদিন তার অনুপস্থিতিতেই দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে নানা কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।