প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২, ০১:৫৪ এএম
প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

জলাতঙ্ক একটি প্রচীন মরণব্যাধি, যা প্রাণী থেকে মানুষে ও প্রাণিতে সংক্রমিত হতে পারে। কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি, শিয়ালের কামড় বা আঁচড়ে রোগটি সংক্রমিত হয়। প্রতিবছর এ রোগে দেশে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে বিশ্বে বছরে এ রোগে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ এই রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য যদি কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি অথবা শিয়াল কামড় বা আঁচড় দেয়, সাথে সাথে সাবান পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান ১৫ মিনিট ধৌত করতে হবে।

এরপর যথাসময়ে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ফরাসি অণুজীববিদ লুইপাস্তুর ১৮৮৫ সালে সর্বপ্রথম জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। অসামান্য এই অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর গ্লোবাল এলায়েন্স ফর র্যাবিস কন্ট্রোল কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুদিবসকে (২৮ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ ও নির্মূলের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশেও প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর ‘মৃত্যু আর নয়, সবার সাথে সমন্বয়’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালিত হচ্ছে। জলাতঙ্ক, মৃত্যু ও সমন্বয় তিনটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দিবসকে সামনে রেখে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আলাদা আলাদা বাণী দিয়েছেন। সে সাথে সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সারা দেশে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ে সেমিনার, মুক্ত আলোচনা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান গ্রহণ করা হয়েছে।

অধিদপ্তর বলছে, জলাতঙ্ক প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে জলাতঙ্কে মৃত্যুহার শূন্যে আনা সম্ভব। এসব সচেতনতা গড়ে তুলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম সামাজিক জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, ফেস্টুন, বিভিন্ন দিবস পালন, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, স্কুল প্রোগ্রাম, জনবার্তাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের নানাবিধ  স্বাস্থ্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ফলে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ কমে এসেছে। জুনোটিক ডিডিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল পর্যায়ে ৩০০টির অধিক জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।

এছাড়াও রাজধানীর মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও পাঁচটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচরে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে জলাতঙ্কের আধুনিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে কুকুর বা অন্যান্য প্রাণীর কামড়/আঁচড়ের আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা ও কামড়ের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা  প্রদান করা হচ্ছে। সরকার প্রতি বছর প্রায় তিন লাখের অধিক জলাতঙ্ক সংক্রমণকারী প্রাণীর কামড়/আঁচড়ের রোগীকে বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা প্রদান করছে। এর ফলে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের গাইডলাইন অনুসারে বর্তমানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের পূর্ণ ডোজ (তিনটি ০, ৩ ও ৭ দিনে) এক সপ্তাহে দেয়ার ফলে রোগীদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সব সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।

এর পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণিদেহে জলাতঙ্কের জীবাণু ল্যাবে নিশ্চিতকরণের কাজ করে চলেছে। এতে করে নির্দিষ্ট স্থানে এ রোগের উপস্থিতি ও প্রাদুর্ভাব নির্ণয় করে মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করে পরিবেশে জলাতঙ্কের প্রধান উৎস কুকুরের মধ্যে ব্যাপক হারে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে।

ব্যাপক হারে কুকুরের টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা দেশে ইতোমধ্যে ৬৪টি জেলায় প্রথম রাউন্ড, ১৭টি জেলায় দ্বিতীয় রাউন্ড এবং ৬টি জেলায় তৃতীয় রাউন্ড ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরকে প্রায় ২২ লাখ ৫১ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা হয়েছে, যা মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।