দেশে প্রকট হয়ে উঠছে জ্বালানি সংকট। এলএনজি আমদানিতে অর্থনীতির ওপর যে চাপ পড়ছে, তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে ডলার সংকটের জন্য একটি বড় কারণ হিসেবে জ্বালানির আমদানি বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন অনেকে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে হিসেবে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) নতুন করে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
সংশিষ্টরা বলছেন, এর ফলে দেশের এলএনজি আমদানির হার কমে আসবে। সংকট নিরসনে সিস্টেম লস কমানোর হচ্ছে বলেও জানায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সারা দেশে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নে তিতাস এবার জোর দিচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সম্প্রতি তিতাসের এক সভায় তিন মাসের মধ্যে অবৈধ সংযোগ শূন্যে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। এতে সাশ্রয় হবে বিপুল গ্যাস। সঞ্চিত গ্যাসে চলমান সংকট অনেকটাই দূর হবে বলে জানান তিনি।
২০২৫ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এই ৪৬টি কূপ খননের কাজ শেষ করা হবে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এই কূপগুলো খনন হলে মিলবে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এতে এলএনজি আমদানি কমানো সম্ভব হবে। এছাড়া সমুদ্রসীমায় নতুন খনি আবিষ্কার হলে জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি সংকটের সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলা বলছে, আগামী সাড়ে তিন বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এতে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাসের সংস্থান হবে। সে আলোকে ইতোমধ্যে কুমিল্লা জেলার শ্রীকাইলে গ্যাস অনুসন্ধানে কূপের খননকাজ শুরু হয়েছে। এই খননকাজ শেষ হলে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতে পারে বলে আশা করছে পেট্রোবাংলা। কুমিল্লা জেলার শ্রীকাইল নর্থ-১-এ অনুসন্ধান কূপের খননকাজ চলছে।
পেট্রোবাংলা আরও জানায়, শ্রীকাইল কূপের গভীরতা হবে ৩৫০০ মিটার। খননকাজে বাপেক্সের নিজস্ব রিগ বিজয়-১২ ব্যবহার করা হচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যে কূপটির খননকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কূপ খনন শেষে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস আবিষ্কৃত হলে দৈনিক ১০-১৫ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন হতে পারে বলে আশা করা যায়।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান আমার সংবাদকে বলেন, আমরা দেশীয় গ্যাসের উৎস অনুসন্ধানে কাজ করে যাচ্ছি। ২০২৫ সালের মধ্যে পেট্রোবাংলা ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে বাপেক্স এ বছরের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে শ্রীকাইল নর্থ-১-এ অনুসন্ধান কূপ খননের কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যে সরকার কূপটির ১৮২ মিটার খননকাজ সম্পন্ন করেছে। এর ফলে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, কূপ খননের অংশ হিসেবে এর বাইরে এখন ওয়ার্কওভারের কাজ চলছে বিয়ানীবাজার-১ এবং ভোলার টবগিতে। এছাড়া খুব শিগগিরই শরীয়তপুর-১ কূপের কাজ শুরু করা হবে। ভোলায় কয়েকটি কূপ খনন করা হবে। ইতোমধ্যেই একটি কূপের খননকাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
এখন দেশে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম এলএনজি আসছে। মূলত কাতার ও ওমানের দুটি কোম্পানির সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি রয়েছে। তারাই এলএনজি সরবরাহ করছে। এর বাইরে স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি আমদানি করা হতো, আপাতত তা বন্ধ রয়েছে। দাম না কমলে স্পট মার্কেট থেকে আর এলএনজি আমদানি করা হবে না। একটি সূত্র জানায়, আসছে শীতে পশ্চিমা দেশগুলোতে ঠাণ্ডার প্রকোপে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আরও একদফা বাড়তে পারে।
এদিকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসছে দেশি উৎস থেকে। দেশি তিনটি কোম্পানি ৮৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। বাকিটা দিচ্ছে বহুজাতিক দুই কোম্পানি শেভরন এবং তাল্লো।
সূত্র বলছে, নতুন ৫৩৪ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন পাইপলাইন এবং ১৫৭ কিলোমিটার ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন বসানোর কাজ চলছে এবং ৬২০ কিলোমিটার তেল সরবরাহের পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। ডবল পাইপলাইন এবং ১৯টি ওয়েলহেড কম্প্রেসারসহ একক পয়েন্ট মুরিং ইনস্টলেশনের কাজ চলছে।
এছাড়া ৪.৭০ লাখ প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হচ্ছে এবং দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক সিসমিক জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। পেট্রোবাংলা গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সাল থেকে ৪৬টি নতুন কূপ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। ৪৬টি নতুন কূপের মধ্যে ১৭টি অনুসন্ধান কূপ, ১২টি উন্নয়ন কূপ এবং ১৭টি ওয়ার্কওভার কূপ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। কূপ খননের প্রস্তুতি ও অগ্রগতি প্রতিবেদনে পেট্রোবাংলা সারা দেশে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক সিসমিক জরিপ করবে। আগামী ছয় বছর পর বড়পুকুরিয়া খনি থেকে ৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলনের চুক্তিও করেছে সরকার। জার্মানির সঙ্গে মধ্যপাড়া গ্রানাইট খনির চুক্তির মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে ১৫টি নতুন কূপ (বাপেক্স ৫, এসজিএফএল ৬, বিজিএফসিএল ৪) প্রতিদিন আরও ২১৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করবে।২০২৪ সালে ১৪টি নতুন কূপ (বাপেক্স ৬, এসজিএফএল ৪, বিজিএফসিএল ৪) প্রতিদিন ১৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালে খনন করা চূড়ান্ত ১১টি কূপ (বাপেক্স ৪, এসজিএফএল ৩, বিজিএফসিএল ৪) প্রতিদিন ১৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া পেট্রোবাংলা গ্যাস বিতরণ কোম্পনিগুলোকে অবৈধ সংযোগ কমানোর তাগিদ দিয়েছে।
সম্প্রতি তিতাস গ্যাস টিঅ্যান্ডডি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, গত ৬ মাসে সোয়া দুই লাখ অবৈধ গ্যাসলাইন বিচ্ছিন্ন করেছে তিতাস। এ সময়ে অভিযান চালানো হয়েছে ১৬৪টি। পাইপ কাটা হয়েছে ২২০ দশমিক ৬৩ কিলোমিটারের সমান।